অর্থনীতি ডেস্ক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিল্প, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, ভর্তুকিনির্ভর কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে দেশের শিল্প খাতকে দীর্ঘমেয়াদে সচল রাখা সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ভবিষ্যতের জন্য টেকসই শিল্পনীতি গড়ে তুলতে দেশি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়ে সরকার কাজ করছে। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে নাটোর চিনিকল পরিদর্শন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে শিল্প উপদেষ্টা বলেন, দেশের চিনিশিল্পের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে পর্যায়ক্রমিক সংস্কার ছাড়া বিকল্প নেই। তিনি জানান, চিনিশিল্পে বর্তমানে উৎপাদন ব্যয় ও বাজারদরের মধ্যে বৈষম্য বিদ্যমান থাকায় ভর্তুকি দিয়ে শিল্প পরিচালনা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ কারণে সরকার চিনিশিল্পকে আধুনিকায়ন, উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং পণ্য বৈচিত্র্যের দিকে নজর দিচ্ছে।
তিনি জানান, চিনিশিল্পে ভর্তুকিনির্ভরতা কমানো ও দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে স্বল্পমেয়াদি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন চিনিকলে উৎপাদিত চিনি মজুত অবস্থায় থাকায় সরকার আগে সেসব চিনি টিসিবির মাধ্যমে বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে একদিকে অভ্যন্তরীণ মজুত ব্যবস্থাপনা সহজ হবে, অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ স্থিতিশীল থাকবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
চিনিশিল্পের পুরোনো যন্ত্রপাতি ও কম উৎপাদনক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ চিনিকল ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত হওয়ায় সেগুলো দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, বর্তমান চাহিদার তুলনায় দেশীয় উৎপাদন অপ্রতুল; ফলে দেশের প্রয়োজনীয় চিনির একটি ছোট অংশই অভ্যন্তরীণ শিল্পে পূরণ করা যায়। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার চিনিশিল্পে বহুমুখী উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে, যাতে শুধু চিনি উৎপাদন নয়—উপ-উৎপাদন, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরির সুযোগ তৈরি হয়।
দেশের শিল্প খাতে দেশি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে শিল্প উপদেষ্টা বলেন, স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন ও টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে দেশি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। তিনি জানান, উদ্যোক্তারা যেন নতুন বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তিতে আগ্রহী হন, সে জন্য সরকার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছে। তাঁর মতে, দেশীয় বিনিয়োগ উৎসাহিত হলে শিল্প খাতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উৎপাদনব্যয় হ্রাস এবং ভবিষ্যতে বিদেশনির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে।
চিনিশিল্পের ধীরগতির মুনাফা নিয়ে তিনি বলেন, চিনি উৎপাদন থেকে খুব দ্রুত বাণিজ্যিক লাভ আসে না। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনানির্ভর একটি শিল্প। তিনি আরও বলেন, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের উন্নতি হলে শিল্পটির আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী করা সম্ভব। শিল্প খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ও বাজারসংগঠনের ওপর কাজ করার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
পরিদর্শনের সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীন, নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাবসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা চিনিকলের বিভিন্ন ইউনিট পর্যবেক্ষণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন।
স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় শিল্প উপদেষ্টা চিনিকলের যন্ত্রপাতি সংস্কার, দক্ষ জনবল উন্নয়ন, কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং বাজারমান বজায় রাখার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চিনিশিল্পের সংস্কার সফল করতে কেন্দ্রীয় সরকারি নীতিমালার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি।
চিনিশিল্পের সম্ভাবনা বিষয়ে তিনি জানান, সঠিক নীতি প্রয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন, গবেষণা ও কৃষি পর্যায়ের উন্নয়ন হলে চিনিশিল্প আবারও টেকসই অবস্থানে ফিরে আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হলে শিল্প খাত অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে আরও বড় অবদান রাখতে পারবে।
পরিদর্শন শেষে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চলমান কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবনা প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেন। শিল্প উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, চলমান উদ্যোগ সফল হলে নিকট ভবিষ্যতে চিনিশিল্পসহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।


