খাদ্যে দূষণ মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

খাদ্যে দূষণ মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

জাতীয় ডেস্ক

রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এক বৈঠকে খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও বিভিন্ন ধরনের দূষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, খাদ্যে ক্রমবর্ধমান দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করছে এবং এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বৈঠকে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়।

বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা জানান, খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের দূষণের উপস্থিতি সম্পর্কে সরকারের কাছে স্পষ্ট তথ্য রয়েছে এবং এ অবস্থায় দ্রুততম সময়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, খাদ্যদূষণের প্রভাবে শিশু, প্রবীণ এবং সাধারণ মানুষ সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এ কারণে সব পক্ষকে একই প্ল্যাটফর্মে এনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেন যে, খাদ্যে দূষণ মোকাবিলায় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপসমূহ লিখিত প্রস্তাব আকারে জমা দিতে হবে। তিনি বলেন, কোন কোন উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে এখনই কার্যকর করা প্রয়োজন, তা পর্যালোচনা করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।

বৈঠকে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে একজন প্রতি বছর খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়, এবং এ ধরনের রোগে আক্রান্ত শিশুদের তিন ভাগের এক ভাগের মৃত্যু ঘটে। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি শিশু খাদ্যবাহিত রোগে ভোগে।

খাদ্যে দূষকের ধরন সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারী ধাতু, কীটনাশক ও জীবনানাশক অবশিষ্টাংশ, তেজস্ক্রিয়তা এবং জৈবদূষক—এই চার ধরনের দূষক সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গত অর্থবছরে ১,৭১৩টি এবং চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৮১৪টি নমুনা পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সীসা বা সীসা-ক্রোমেট পাওয়া গেছে। মোট ১৮০টি নমুনার মধ্যে ২২টিতে অতিরিক্ত সীসা শনাক্ত হয়।

এক যৌথ গবেষণায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পানি ও মাছের নমুনায় ৩০০ ধরনের ওষুধ, ২০০ ধরনের কীটনাশক এবং ১৬ ধরনের পিএফএএস শনাক্ত হওয়ার তথ্য উপস্থাপন করা হয়। গবেষণা অনুযায়ী, এসব রাসায়নিকের ধারাবাহিক সংস্পর্শ দীর্ঘমেয়াদে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, হরমোন, কিডনি ও যকৃৎের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

ইউনিসেফের এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি শিশু সীসার সংস্পর্শে আছে, যা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও শারীরিক সক্ষমতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জানান, মানবদেহে সীসা জমলে তা মস্তিষ্ক, হাড়, যকৃৎ ও কিডনিতে দীর্ঘসময়ের জন্য থেকে যায় এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও বেশি মারাত্মক। গর্ভবতী নারীদের মধ্যেও ব্যবসায়িক নমুনা বিশ্লেষণে পাঁচ শতাংশ সীসা সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি জানান, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ সমস্যা মোকাবিলায় ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।

বৈঠকে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হাঁস-মুরগি, দুগ্ধজাত খাদ্য ও মাছের উৎপাদন ব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ ও কীটনাশক ব্যবহারের ঝুঁকি তুলে ধরেন। তারা জানান, অনেক পোল্ট্রি খামারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর নির্ধারিত ৭ থেকে ২৮ দিনের ‘উইথড্রয়াল পিরিয়ড’ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এ সময়ের আগেই বাজারজাত করলে তা ভোক্তাদের দেহে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করাতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বাড়ায়।

পোল্ট্রি খামারগুলোকে নিয়মিত নজরদারির আওতায় আনা, কৃষিতে অবৈধ কীটনাশক ব্যবহার রোধ এবং খাদ্য মূল্যশৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে কঠোর তদারকি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারে আধুনিক ল্যাবরেটরি সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা এবং মাঠপর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েও মতবিনিময় হয়।

খাদ্য উপদেষ্টা বৈঠকে উল্লেখ করেন, পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে গিয়ে খাদ্যের নিরাপত্তা অনেক সময় উপেক্ষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে শিক্ষা কার্যক্রম ও গণমাধ্যম উভয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তিনি পাঠ্যপুস্তকে খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও উপস্থাপন করেন।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ