গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিচয় শনাক্তে রায়েরবাজার কবরস্থানে মরদেহ উত্তোলন শুরু

গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিচয় শনাক্তে রায়েরবাজার কবরস্থানে মরদেহ উত্তোলন শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে নিহত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থান থেকে মরদেহ উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। রোববার, ৭ ডিসেম্বর সকাল থেকে সংস্থাটি আদালতের নির্দেশনা অনুসারে এই কাজ শুরু করে। উত্তোলনের পর মরদেহগুলোতে ফরেনসিক পরীক্ষার অংশ হিসেবে ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। পরবর্তী সময়ে যথাযথ ধর্মীয় ও আইনগত প্রক্রিয়া মেনে মরদেহ পুনরায় দাফন করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রায়েরবাজার কবরস্থানের যে স্থানে গণঅভ্যুত্থানে নিহত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দাফন করা হয়েছিল, সেখানে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিশেষভাবে মার্বেল পাথর ও টাইলস স্থাপন করে চিহ্নিত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে অজ্ঞাত পরিচয়ে দাফন থাকা এসব মরদেহ শনাক্তের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে পরিবারগুলোর আবেদন এবং তদন্ত সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে উত্তোলনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়।

সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি (প্রধান) মো. সিবগত উল্লাহ জানান, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের অধীনস্থ এ স্থানে ফরেনসিক প্রক্রিয়ার জন্য মরদেহ উত্তোলন করা হচ্ছে। তাঁর ভাষ্যমতে, নিহতদের পরিচয় শনাক্তে এ পর্যন্ত ১০ জন আবেদন করেছেন। তবে প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, সেখানে দাফন করা শহিদের সংখ্যা ১১৪ জনের চেয়েও বেশি হতে পারে। যারা নিহতদের স্বজন হিসেবে পরিচয় দাবি করবেন এবং ডিএনএ মিলের মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত হবে, তাঁদের কাছে মরদেহ হস্তান্তরের সুযোগ রাখা হবে বলে জানান তিনি।

সিআইডির গণমাধ্যম শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান বলেন, মরদেহ উত্তোলন ও ফরেনসিক পরীক্ষার জটিলতা বিবেচনায় সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এজন্য সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট বিভিন্ন সময় কবরস্থানে গিয়ে স্থানটি পরিদর্শন ও নমুনা সংগ্রহ-সংক্রান্ত প্রাথমিক মূল্যায়ন করেছে। তাঁর মতে, প্রতিটি ধাপ আন্তর্জাতিক ফরেনসিক প্রটোকল অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হচ্ছে, যাতে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ নির্ভুলতা নিশ্চিত হয়।

আদালতের নির্দেশনার পটভূমিতে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহিদুল ইসলামের আবেদনের ভিত্তিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফনকৃত ১১৪টি মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেন। আদালত জানান, গণঅভ্যুত্থানে নিহত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করে আইনগত প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পর্কিত তথ্য নথিভুক্ত করা এবং সম্ভাব্য স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান দেখা দেয়। বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই সময় উদ্ধারকৃত বেশ কয়েকটি মরদেহ পরিচয়হীন অবস্থায় রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেও বহু পরিবার নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বহু পরিবারের দাবি—সম্ভবত তাঁদের স্বজনদেরই কেউ রায়েরবাজারে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে।

মরদেহ উত্তোলন ও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এই অজ্ঞাতপরিচয় নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত মামলার অগ্রগতি এবং রাষ্ট্রীয় রেকর্ড সংশোধনের ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া পরিবারের জন্য এটি দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে। পরিচয় শনাক্ত হলে পরিবারগুলো আইনগতভাবে মৃত্যুসনদসহ অন্যান্য নথি প্রাপ্তির সুযোগ পাবে, যা ক্ষতিপূরণ, সম্পদ উত্তরাধিকার বা সামাজিক পরিচয় পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।

সিআইডি জানিয়েছে, ফরেনসিক বিশ্লেষণের অংশ হিসেবে প্রতিটি মরদেহের হাড়, দাঁত, টিস্যু ও অন্যান্য সম্ভাব্য অবশিষ্টাংশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এসব নমুনা জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে, যেখানে আধুনিক ডিএনএ প্রোফাইলিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি কবরস্থানে দাফনকৃত মরদেহগুলোর অবস্থান, কফিনের কাঠামো, দাফনের ধরন এবং ব্যবহৃত সামগ্রীর উপরও তদন্তকারীরা নজর দিচ্ছেন, যা ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা করছেন, উত্তোলন ও নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষাগার বিশ্লেষণে কিছুটা সময় লাগলেও শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে নিহতদের পরিচয় সংক্রান্ত একটি আনুষ্ঠানিক তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হবে। এতে গণঅভ্যুত্থানের সময়কার সঠিক হতাহতের পরিসংখ্যান আরও নির্ভুলভাবে নির্ধারণে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ গবেষণা ও নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় এ তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

উত্তোলন কাজ চলাকালে কবরস্থান এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, সিআইডি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে প্রতিটি ধাপ তদারকি করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পরিবারের আবেগকে সম্মান জানিয়ে এবং বৈজ্ঞানিক প্রটোকল অনুসরণ করে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ চলছে।

আইন আদালত শীর্ষ সংবাদ