টাইফয়েড প্রতিরোধে টিসিভি ক্যাম্পেইনে ৪ কোটি ২৫ লাখের বেশি শিশুকে টিকার আওতায় আনলো বাংলাদেশ

টাইফয়েড প্রতিরোধে টিসিভি ক্যাম্পেইনে ৪ কোটি ২৫ লাখের বেশি শিশুকে টিকার আওতায় আনলো বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পরিচালিত টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) ক্যাম্পেইনে দেশের ৪ কোটি ২৫ লাখেরও বেশি শিশুকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স এই তথ্য জানিয়েছেন। তার মতে, সরকারের এ উদ্যোগ টাইফয়েড প্রতিরোধে দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এই বৃহত্তম টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৯৭ শতাংশের বেশি শিশুকে টিসিভি টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যা শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি বড় সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, বিশ্বের মাত্র আটটি দেশে এ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ক্যাম্পেইন চালু করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। তিনি উল্লেখ করেন, দেশের অনেক শিশু প্রতিদিন দূষিত পানির সংস্পর্শে থাকায় টাইফয়েড সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি, এবং এ অবস্থায় টিসিভি টিকা তাদের সুরক্ষার একটি কার্যকর উপায়।

সাম্প্রতিক মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাত্র ৩৯.৩ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনার আওতায় রয়েছে। পানির বিভিন্ন উৎসের প্রায় অর্ধেকে ই. কোলাই জীবাণু পাওয়া গেছে, আর পরিবারের ব্যবহৃত পানির ৮৫ শতাংশেই এ দূষণের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এসব তথ্য শিশুদের মধ্যে টাইফয়েডসহ পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি কতটা উদ্বেগজনক তা নির্দেশ করে। ইউনিসেফ প্রতিনিধি বলেন, নিরাপদ পানি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা হিসেবে কাজ করবে।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, পুরো ক্যাম্পেইন পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি ৫ কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করেছে। এছাড়া নতুন কোল্ড রুম স্থাপন, কোল্ড চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভ্যাক্সইপিআই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে টিকা ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমেও সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ টিকাদান প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনায় ভূমিকা রাখে।

ক্যাম্পেইনের সফলতার অন্যতম উপাদান ছিল যোগাযোগ ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং কমিউনিটি পর্যায়ের অংশীদারদের সম্পৃক্ত করে শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষার বার্তা প্রচার করা হয়। টেলিভিশন, রেডিও এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটির বেশি মানুষের কাছে টিকাদান সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এতে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং টিকাদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণও উৎসাহিত হয়।

দেশের দুর্গম উপকূলীয় অঞ্চল, জলাভূমি, পাহাড়ি এলাকা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসতি, চা-বাগান এলাকা, কওমি মাদরাসা, ভ্রাম্যমাণ পরিবার এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর শিশুরাও এই কর্মসূচির আওতায় এসেছে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রোহিঙ্গা শিবিরেও ৪ লাখ ২৪ হাজার শিশুকে টিসিভি টিকা প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্যও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।

রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ক্যাম্পেইনের সাফল্য অর্জনে বাংলাদেশ সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইপিআই কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা এবং বিভিন্ন অংশীদার প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, টিকাদানসংক্রান্ত যেকোনো গুজব মোকাবিলায় সঠিক তথ্য প্রচার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যা পরিবারগুলোর আস্থা বৃদ্ধি করেছে। তার মতে, টিকা শুধু একটি প্রতিষেধক নয়; এটি ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং একটি সুস্থ প্রজন্ম গঠনের ভিত্তি।

টিসিভি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ টাইফয়েড প্রতিরোধে একটি বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহব্যবস্থা এখনও পর্যাপ্তভাবে উন্নত না হওয়ায় রোগ প্রতিরোধে টিকাদান অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এ কর্মসূচি ভবিষ্যতে টাইফয়েড সংক্রমণের হার কমাতে সহায়ক হতে পারে এবং শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, টিসিভি টিকাদান কর্মসূচি বাংলাদেশে শিশুস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধে একটি মডেল উদ্যোগ হিসেবে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি, টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হওয়ায় সার্বিক রোগপ্রবণতা হ্রাসের সম্ভাবনাও বাড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ ও স্যানিটেশন উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।

টাইফয়েড প্রতিরোধে এ উদ্যোগ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, এ ধরনের সমন্বিত কার্যক্রম ভবিষ্যতে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং একটি স্বাস্থ্যসম্মত সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।

শীর্ষ সংবাদ স্বাস্থ্য