জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা বেশ কয়েকটি বিধান অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের শুনানি সর্বোচ্চ আদালতে শুরু হয়েছে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে এ শুনানি শুরু হয়। আবেদনের পক্ষে ব্যারিস্টার ড. শরীফ ভূঁইয়া যুক্তি উপস্থাপন করছেন।
গত ১৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের অনুমতি দেয়। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালসহ পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কিছু বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক—এ রায়কে চূড়ান্ত পর্যায়ে পর্যালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক।
গত ৩ নভেম্বর রিটকারী সংগঠন সুজনের পক্ষে সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের নির্দেশে ব্যারিস্টার ড. শরীফ ভূঁইয়া লিভ টু আপিল আবেদন করেন। এতে পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা বাতিলের আবেদন জানানো হয়। এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ঘোষণা করেন এবং গণভোট পুনর্বহালের নির্দেশ দেন। তবে সংশোধনীর পুরোটা বাতিল করা হয়নি।
হাইকোর্ট তার রায়ে উল্লেখ করেন যে গণতন্ত্র সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে তা বিকাশ লাভ করে। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের মতামতের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে জনগণের আস্থাহীনতার কারণেই পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণআন্দোলনের ঘটনা ঘটে।
রায়ে আরও বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল এবং তা সময়ে সময়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ৭ক, ৭খ ও ৪৪(২) অনুচ্ছেদও বাতিল করা হয়।
৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল কিংবা স্থগিতকরণকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ ছিল। ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ৪৪(২) অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিধান ছিল, যা সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছিল। আদালত বলেন, এসব পরিবর্তন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
গণভোটের বিধান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ হিসেবে কার্যকর ছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটি বিলুপ্ত করা হয়। হাইকোর্ট এ বিধান পুনর্বহাল করেন এবং সংশোধনী আইনের ওই অংশকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। আদালত পর্যবেক্ষণ করেন, সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুতর বিষয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত গ্রহণের বিধান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে সহায়ক।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মোট ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতি, ২৬ মার্চের ভাষণসহ ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি উপাদান যুক্ত করা হয়। হাইকোর্ট তার রায়ে বলেন, যেসব বিধান সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেগুলো বলবৎ থাকবে। তবে ভবিষ্যতে কোনো সরকার চাইলে জনগণের মতামত নিয়ে সেসব বিধানে সংশোধন আনতে পারবে।
দীর্ঘ শুনানি শেষে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ হওয়ার বিষয়ে জারিকৃত রুলের রায় ঘোষণা করার জন্য দিন নির্ধারণ করেন। এর আগে গত বছরের ১৯ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রুল জারি করা হয়েছিল। রুলে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পক্ষ ইন্টারভেনর হিসেবে যুক্ত হয়, যার মধ্যে ছিল রাজনৈতিক দলের মহাসচিব, পেশাজীবী সংগঠন এবং স্বাধীন আবেদনকারীরা।
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয় এবং নারী আসন বৃদ্ধি, সংবিধানের প্রস্তাবনা ও বেশকিছু ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। সংশোধনীটির পর থেকেই এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক চলমান রয়েছে এবং হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ে তা বিচারাধীন রয়েছে।
বর্তমানে আপিল বিভাগের চলমান শুনানিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রশ্ন এবং মৌলিক কাঠামো তত্ত্বের প্রয়োগ—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। দীর্ঘায়িত এ বিচারিক প্রক্রিয়ার রায় দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, নির্বাচন ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এবং সংবিধান সংশোধনের নীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে বলে আইনবিশেষজ্ঞরা মনে করেন।


