আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) নীতিনির্ধারক বৈঠকে মূল নীতি সুদ বা রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৫.২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ ১৬ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ তারল্য সরবরাহের উদ্যোগ ঘোষণা করেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং মুদ্রার ওপর চাপ মোকাবিলায় এই সমন্বিত নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক জানিয়েছে, সুদের হার হ্রাসের লক্ষ্য হলো ঋণপ্রাপ্তি সহজ করা, অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখা এবং আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
এই নীতি পরিবর্তন এমন সময়ে এলো যখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের ওপর উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপ নীতি ভারতীয় রপ্তানি খাত, বাণিজ্য ভারসাম্য ও বৈদেশিক লেনদেনে প্রভাব ফেলছে। শুল্কবিধির কারণে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে এবং দেশটির মুদ্রা রুপির মূল্য বেশ কিছুদিন ধরে নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রা বিনিময়ের ওঠানামা দেশের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে আরবিআইয়ের সুদের হার ও তারল্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাজারে আস্থা পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে আরবিআই মোট ১২৫ বেসিস পয়েন্ট নীতি সুদ কমিয়েছে, যা ২০১৯ সালের পর সুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ধারাবাহিক হ্রাস। আরবিআই গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা বৈঠক শেষে জানিয়েছেন, ভারত বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে রয়েছে যেখানে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় নেমে এলেও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তিনি এই পরিস্থিতিকে ‘বিরল গোল্ডিলকস’ সময় হিসেবে উল্লেখ করেন, যেখানে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী ও প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী—অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য একটি বিরল এবং অনুকূল অবস্থা।
মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতের মুদ্রানীতি শিথিল করার পক্ষে প্রধান যুক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। অক্টোবর থেকে খুচরা মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত কমতে শুরু করে এবং তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিম্নতম সহনশীলতা সীমারও নিচে নেমে যায়। অক্টোবর মাসে খুচরা মূল্যস্ফীতি সর্বকালের সর্বনিম্ন ০.২৫ শতাংশে নেমে আসা ভারতের মুদ্রা বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মুদ্রাস্ফীতির এই নিম্নগতি অভ্যন্তরীণ চাহিদা, সরবরাহ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক পণ্যমূল্যের ওঠানামার মধ্যে নতুন ভারসাম্যের সূচনা করেছে বলে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ইতিবাচক অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬.৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৩ শতাংশ করেছে। বৈশ্বিক মন্দাভাব ও বাণিজ্য অনিশ্চয়তার মধ্যেও ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অবকাঠামো খাত ও সেবা খাতে শক্তিশালী কর্মক্ষমতা প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি খাত ও উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রবণতা আরবিআইয়ের পূর্বাভাসকে সমর্থন করে।
অন্যদিকে, মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস ২.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়েছে আরবিআই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, কৃষিপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ, খাদ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্য সীমিত ওঠানামা মুদ্রাস্ফীতি কমার পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তবে আরবিআই সতর্ক করে জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য অস্থিরতা, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং লজিস্টিক খরচ বৃদ্ধি ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতির ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বৈদেশিক খাতের স্থিতিশীলতা সম্পর্কেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আরবিআই গভর্নর। তিনি বলেছেন, ভারতের বৈদেশিক খাত ‘স্থিতিস্থাপক’ অবস্থানে রয়েছে এবং বৈদেশিক অর্থায়ন প্রয়োজনীয়তা ‘আরামদায়কভাবে’ পূরণ করা হবে। বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা মিলিয়ে ভারতের বৈদেশিক লেনদেনের সক্ষমতা বজায় থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই সব বিবেচনায়, সুদের হার হ্রাস ও তারল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোতে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ঋণপ্রাপ্তি সহজ হলে ব্যবসায়িক ব্যয় কমবে, বিনিয়োগের হার বাড়বে এবং ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতির গতি আরও ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে বাহ্যিক চাপ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতি এবং মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা ভবিষ্যতে আরবিআইয়ের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


