আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবমাননা মামলায় ফজলুর রহমানকে অব্যাহতি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবমাননা মামলায় ফজলুর রহমানকে অব্যাহতি

আইন আদালত ডেস্ক

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে জনসম্মুখে বিরূপ মন্তব্য করায় আদালত অবমাননার অভিযোগে তলবের পর নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফজলুর রহমানকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন।

ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষে হাজির ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। ফজলুর রহমানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

শুনানির শুরু থেকে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন ফজলুর রহমান। পরে আইনজীবীর অনুমতি নিয়ে তিনি আসনে বসেন। এ সময় তিনি পূর্বে একটি টেলিভিশন টকশোতে দেওয়া বক্তব্যের জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে অনুকম্পা প্রার্থনা করেন এবং নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চান। তাঁর এ অনুতাপ ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে সতর্ক করে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়।

সকালে আইনজীবীদের একটি দল নিয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে আদালত কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে ৩০ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাখ্যা জানতে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে তলব করেছিল। তলবের পর তিনি সশরীরে হাজির হওয়ার পাশাপাশি লিখিতভাবেও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ওই লিখিত ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি প্রসিকিউশন পূর্বেই আদালতকে জানায়।

প্রসিকিউশন জানায়, ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা, আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে মন্তব্য করা এবং প্রসিকিউশনকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান—এই তিন কারণে তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগের প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয় ২৬ নভেম্বর। এরপর ৩০ নভেম্বর অবশিষ্ট শুনানি শেষে ব্যাখ্যা জানতে তাঁকে তলব করা হয়।

অভিযোগ অনুযায়ী, একটি টেলিভিশন টকশোতে অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউশন সম্পর্কে একাধিক বিরূপ মন্তব্য করেন ফজলুর রহমান। তাঁর বক্তব্যের পূর্ণাঙ্গ ভিডিও প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে এবং শুনানিতে এর কিছু অংশ উপস্থাপন করা হয়। ভিডিওতে তিনি ট্রাইব্যুনালের গঠনপ্রক্রিয়া, এখতিয়ার ও অতীত রায়প্রদান প্রসঙ্গ তুলে তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি আরও জানান যে পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত মাধ্যমে একই ধরনের বক্তব্য তিনি প্রকাশ করেছিলেন।

প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম ট্রাইব্যুনালকে জানান, সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকা সত্ত্বেও এসব মন্তব্য করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ফজলুর রহমান নিজেকে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার বহির্ভূত দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। শুনানিতে ট্রাইব্যুনাল তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কেও জানতে চায়। তখন জানানো হয়, তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।

ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে উল্লেখ করে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণীত হয় ১৯৭৩ সালে, এবং এ আইন অনুযায়ী ১৯৭১ সালের আগে ও পরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। আদালত আরও স্পষ্ট করে যে প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, ফলে তাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য আদালত অবমাননার শামিল।

ভিডিও ফুটেজসহ উপস্থাপিত সামগ্রিক তথ্য পর্যালোচনা করে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগকে গুরুতর বলে উল্লেখ করে। সেই প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা শুনতে ৮ ডিসেম্বর সশরীরে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে হাজির হয়ে ফজলুর রহমান ক্ষমা প্রার্থনা করলে আদালত তাঁর অনুতাপ গ্রহণ করে।

বিচারিক প্যানেল রায়ে উল্লেখ করে, আদালতের প্রতি আনুগত্য বা ভক্তি প্রদর্শন আদালত অবমাননা মামলার উদ্দেশ্য নয়; বরং আদালতের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও বিচারব্যবস্থার প্রতি জনবিশ্বাস অটুট রাখাই এ ধরনের আইনের মূল উদ্দেশ্য। অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর মন্তব্যে আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হলেও, তাঁর আন্তরিক অনুতাপ ও ভবিষ্যতে এ ধরনের মন্তব্য থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার বিবেচনায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আদালত আশা প্রকাশ করে যে ভবিষ্যতে তিনি বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং জনসম্মুখে আদালত বা প্রসিকিউশন সম্পর্কে কোনো ধরনের অপমানজনক বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকবেন। এ নির্দেশনা সাপেক্ষে আদালত অবমাননার অভিযোগের কার্যক্রম নিষ্পত্তি করা হয়।

আইন আদালত