আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইসরায়েলের চলমান দুর্নীতি মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি চেয়ে প্রেসিডেন্ট ইসাক হেরজগের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। একই সঙ্গে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য হেরজগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে প্রেসিডেন্ট হেরজগ জানিয়েছেন, এ ধরনের অনুরোধ বিবেচনায় নিলেও তিনি কেবল রাষ্ট্রের আইন ও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন এবং কোনো বাহ্যিক চাপকে প্রাধান্য দেবেন না।
গত রবিবার প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট হেরজগ বলেন, নেতানিয়াহুর পাঠানো চিঠি তার দপ্তর গ্রহণ করেছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, চিঠিতে করা অনুরোধটি ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নাগরিকদের স্বার্থ, বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্থিতিশীলতাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা জরুরি। এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের অবস্থান ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে না।
ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জেরুজালেম জেলা আদালতে ঘুষ, প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে তিনটি পৃথক দুর্নীতি মামলা চলছে। ২০১৯ সালে এসব মামলার অভিযোগপত্র দাখিল এবং বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। মামলাগুলো দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে, যা এখনো অব্যাহত।
একটি মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, নেতানিয়াহু ও তার স্ত্রী সারাহ বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অলঙ্কার, দামী সিগার ও উচ্চমূল্যের মদ উপহার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এসব উপহারের বাজার মূল্য প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার ডলার বলে উল্লেখ করা হয়। এই ধরনের উপহার গ্রহণকে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘনের শামিল হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্যে এসব গ্রহণ করেছিলেন।
দ্বিতীয় মামলায় বলা হয়েছে, দেশের গণমাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে তিনি কিছু মিডিয়া মালিককে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। এতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। মিডিয়া ও সরকারের সম্পর্ক ইসরায়েলের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বহুদিন ধরে, এবং এই মামলাটি সেই বিতর্ককে আরও তীব্র করেছে।
তৃতীয় মামলায় অভিযোগ রয়েছে, ইসরায়েলের অন্যতম শীর্ষ টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ থেকে নেতানিয়াহু ঘুষ নেন। অভিযোগ করা হয়, এই সুবিধার বিপরীতে তিনি এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন যা সরকার ও জনগণের স্বার্থের বিপরীতে ছিল। অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে এগুলো দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক দুর্নীতি মামলাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
২০১৯ সালে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর সময় নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী থাকায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একাধিকবার মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিলম্ব বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন তোলে। পরে ২০২১ সালের জুনে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হলে মামলাগুলো আবারও সক্রিয় করা হয় এবং নিয়মিত শুনানি শুরু হয়।
২০২১ সাল থেকে বিচারিক কার্যক্রম নিয়মিত চললেও গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। নিরাপত্তা অস্থিরতার কারণে বিচারমন্ত্রী জরুরি নির্দেশ জারি করে মামলার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে পুনরায় মামলাগুলোর শুনানি শুরু হয়।
মামলার প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হওয়ার পরই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক সম্পর্ক বরাবরই ঘনিষ্ঠ হলেও হেরজগ স্পষ্ট করেন যে, ইসরায়েল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং তার আইনব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি বলেন, আইনি প্রক্রিয়া স্বাধীনভাবে এগোবে এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সেই প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, চলমান মামলাগুলো দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ, সরকার পরিচালনা ও জনআস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা ইসরায়েলের ক্ষমতাকাঠামোকে পুনঃসংগঠনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, তাকে অব্যাহতি দেওয়া হলে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে প্রেসিডেন্ট হেরজগের সামনে দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, নাগরিকদের আস্থা এবং বিচারকার্যক্রমের স্বচ্ছতা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। নেতানিয়াহুর চিঠি প্রক্রিয়াধীন থাকলেও প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে পরিষ্কার যে, ইসরায়েলের আইন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোই এ বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেবে।


