থাই–কম্বোডিয়া সীমান্তে নতুন করে সেনা সংঘাত, উত্তেজনা বেড়েছে

থাই–কম্বোডিয়া সীমান্তে নতুন করে সেনা সংঘাত, উত্তেজনা বেড়েছে

 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রোববার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা নতুন করে তীব্রতা লাভ করে। সেদিন থাইল্যান্ডের সি সা কেত প্রদেশের সীমান্ত অঞ্চলে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত দুই থাই সেনা আহত হন বলে থাই সামরিক বাহিনী জানিয়েছে।

থাই সেনাবাহিনীর এক সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে সি সা কেত প্রদেশের থাই ভূখণ্ড লক্ষ্য করে কম্বোডীয় বাহিনী গুলি ছোড়ে। এতে একজন সেনা সদস্যের পায়ে গুলি লাগে এবং আরেকজন বুকে আঘাত পান। আকস্মিক এ হামলার পর থাই বাহিনী পাল্টা জবাব দেয় এবং দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ৩৫ মিনিট পর্যন্ত গুলি বিনিময় চলে। পরে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হলেও সীমান্তজুড়ে সতর্কতা জোরদার করা হয়।

সংঘাত থামার পর থাই কর্তৃপক্ষ সীমান্তবর্তী চার প্রদেশ—বুরি রাম, সুরিন, সি সা কেত ও উবন রাতচাথানি—থেকে কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। সীমান্তে সম্ভাব্য নতুন সহিংসতার ঝুঁকি বিবেচনায় এই সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসন আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে নাগরিকদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে বলেও জানা যায়।

রোববারের এ হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই থাইল্যান্ড জাতিসংঘের কাছে কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। থাই সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, কম্বোডিয়া গোপনে সীমান্তবর্তী থাই ভূখণ্ডে বিপুল পরিমাণ ল্যান্ডমাইন পেতেছে, যার বিস্ফোরণে একাধিক থাই ও চীনা নাগরিক আহত হয়েছেন। থাই সরকার জাতিসংঘকে এ ঘটনাটি তদন্তের আহ্বান জানায় এবং সীমান্ত এলাকায় আন্তর্জাতিক নজরদারি জোরদারের অনুরোধ করে। অভিযোগ জানানোর অল্প সময় পরই সি সা কেতে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটায় নতুন করে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে।

দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ নতুন নয়। সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন কৌশলগত স্থাপনা, সীমারেখা নির্ধারণ এবং ঐতিহাসিক দাবিদাওয়া ঘিরে বহু বছর ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চল ও বনাঞ্চলজুড়ে ল্যান্ডমাইন পাতা এবং সীমান্ত চিহ্ন নিয়ে বিরোধ অতীতেও বহুবার দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনার প্রভাবে সীমান্ত এলাকার বাণিজ্য, জনজীবন ও নিরাপত্তা বারবার হুমকির মুখে পড়েছে।

গত জুলাই মাসে ১৫ বছরের যুদ্ধবিরতি ভেঙে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ দিন ধরে চলা সেই সংঘাতে দুই দেশের মোট ৩২ জন নাগরিক প্রাণ হারান এবং আহত হন অন্তত ৩০ জন। আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়তে থাকায় পরবর্তীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি পুনর্বহাল হয়। তবে সীমান্তে অস্থিরতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সেই সময় থেকেও পুরোপুরি কাটেনি।

জুলাইয়ের সংঘাতের পর দুই দেশ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসার চেষ্টা করলেও সীমান্তরেখা চিহ্নিতকরণ, অতীতের ক্ষতিপূরণ দাবি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই মতবিরোধ রয়ে গেছে। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বসবাসকারী মানুষদের জন্য অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে, কারণ তারা নিয়মিতভাবে সম্ভাব্য সংঘাতের ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, সীমান্তে স্থায়ী সমাধানের জন্য দুই দেশের স্থলসীমা নির্ধারণ কমিশনের কার্যক্রম দ্রুত ও কার্যকরভাবে পুনরায় শুরু করা জরুরি।

রোববারের তাজা সংঘর্ষ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েনকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। থাই কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সীমান্তে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছে এবং নজরদারি বাড়িয়েছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকেও সীমান্ত এলাকায় পর্যবেক্ষণ জোরদার করার পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলে আঞ্চলিক কূটনৈতিক সূত্রগুলো ধারণা করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া উভয় দেশের জন্যই সীমান্তে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে দুই দেশের বাণিজ্য, পর্যটন ও স্থানীয় অর্থনীতি নির্ভরশীল। অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলে এসব খাত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। একই সঙ্গে মানবিক পরিস্থিতিও জটিল হয়ে উঠতে পারে, কারণ সীমান্তের উভয় পাশেই বিপুলসংখ্যক মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঘনিষ্ঠভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের কাছে দেওয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে সীমান্তে বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে দুই দেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ কতটা কার্যকরভাবে এগোবে, তা এখন মূল প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক সহিংসতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সীমান্তে উত্তেজনা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবারও অস্থিরতায় নিমজ্জিত হতে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ