আইন আদালত ডেস্ক
দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন। তাঁর অবসর ঘনিয়ে আসায় সুপ্রিম কোর্টসহ আইনাঙ্গনে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগকে ঘিরে জোর আলোচনা চলছে। প্রচলিত রীতি অনুসারে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলেও সাংবিধানিক ক্ষমতা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
বর্তমান প্রধান বিচারপতির বাইরে আপিল বিভাগে ছয়জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে তারা হলেন—বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। এদের মধ্যে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নাম সম্ভাব্য পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে বেশি আলোচিত হচ্ছে।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগে পূর্ণ ক্ষমতা ধারণ করেন। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন এবং পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে অন্যান্য বিচারক নিয়োগ করবেন। একই সঙ্গে ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকলে বা দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারপতি সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। যদিও সংবিধানে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগের বাধ্যবাধকতা নেই, দীর্ঘদিন ধরে রীতি হিসেবে আপিল বিভাগের শীর্ষ জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি করার বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে।
গত জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় একটি ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে উচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসেবে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। সে সময় প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে দায়িত্ব দেয়। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হলেও এবার পরিস্থিতি নিয়মতান্ত্রিক ধারা অনুসরণের দিকেই যাচ্ছে বলে আইনাঙ্গনে মত পাওয়া যাচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের যেকোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়াই শ্রেয়; তবে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা বিচারপতিদের মধ্যে প্রথম দুই জ্যেষ্ঠ—বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নামই অধিকাংশের আলোচনায় রয়েছে।
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ১৯৫৯ সালের ১৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এ কে এম নুরুল ইসলাম ছিলেন দেশের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মা জাহানারা আরজু একুশে পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি ১৯৮৩ সালে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ২০০৫ সালে স্থায়ী বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ২০২২ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হন। পেশাগত জীবনে তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও দেওয়ানি বিষয়ে রায় দিয়ে বিচারাঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন।
বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ১৯৬১ সালের ১৮ মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা প্রয়াত এএফএম আবদুর রহমান চৌধুরীও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর আরেকটি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০০৩ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান এবং পরবর্তীতে স্থায়ী হন। ২০২৪ সালের আগস্টে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর বিচারিক দায়িত্বপালনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক আইনে দক্ষতা তাঁকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে।
এ ছাড়া আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ বিচারিক কর্মজীবনের ইতিহাস রয়েছে। বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তরের একটি সিদ্ধান্ত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা, মামলা নিষ্পত্তির গতি এবং সার্বিক বিচার প্রশাসনের ধারাবাহিকতা নির্ভর করে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বপালনের ওপর। ফলে আগামী ২৭ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধান বিচারপতির অবসরের পর নতুন প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন—এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের ভবিষ্যৎ কাঠামো ও বিচারব্যবস্থার গতি নির্দেশ করবে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।
আইনাঙ্গনে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু এখন রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত। সাংবিধানিক বিধান, প্রচলিত রীতি, জ্যেষ্ঠতা এবং বিচারকদের ব্যক্তিগত সক্ষমতা—সবকিছু বিবেচনার মধ্য দিয়েই নতুন প্রধান বিচারপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।


