জাতীয় ডেস্ক
২০১৩ সালের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে সংঘটিত সহিংসতার সময়কার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তথ্যউপাত্ত তুলে ধরে একটি দীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সোমবার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভেরিফায়েড পেজে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে তিনি সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ, হতাহতের তথ্য সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করেন। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন যে, তৎকালীন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
বিবৃতি অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৫ মে রাতেই শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় প্রথম দফায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়। মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর ও নাইটিঙ্গেল মোড় এলাকায় সংঘর্ষ চলছিল এবং পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তিনি উল্লেখ করেন, সে সময় এলাকাটিতে অবস্থানরত সংবাদকর্মীরা শাপলা চত্বরে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়, সংঘর্ষের গতিপ্রকৃতি এবং রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়ভাবে আনা হতাহতদের চিত্র প্রত্যক্ষ করেন। তবে মৃতদের পরিচয় বা মৃত্যুর কারণ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, রাত আটটার দিকে শাহিদবাগ-মালিবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয়জন নিহতের তথ্য পাওয়া যায়, যাদের মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। হাসপাতাল থেকে তথ্য যাচাইয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তা নিশ্চিত করতে সময় লাগে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় উৎস থেকে তথ্য নিশ্চিত হলে ঘটনাটিকে তাৎপর্যপূর্ণ দাবি করে তিনি উল্লেখ করেন যে, হতাহতের সংখ্যা সে সময় স্থানীয়ভাবে প্রচারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে প্রত্যেকটি ঘটনার পৃথক উৎস উল্লেখ করতে হয়েছিল, যা সে সময়ের প্রতিবেদনকে জটিল করে তুললেও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
পরদিন কাকরাইল এলাকার একটি হাসপাতালে অতিরিক্ত হতাহতের তথ্য পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। পাশাপাশি সমসাময়িক সূত্রের বরাতে উল্লেখ করেন যে, নারায়ণগঞ্জের কাচপুর–সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ভোরে বাড়ি ফেরার পথে একটি বড় দলের ওপর গুলিবর্ষণের অভিযোগ ওঠে, যেখানে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে জানতে পারেন। এসব ঘটনার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য সরবরাহ না করায় পরিস্থিতি বোঝা আরও কঠিন হয়ে ওঠে বলে তিনি দাবি করেন।
বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গুলিবর্ষণ বা হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকে একটি বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরেন। তাদের মতে, সহিংসতা মোকাবিলায় খুব অল্পসংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে মাঠপর্যায়ে পাওয়া তথ্য ও হাসপাতালভিত্তিক যাচাইক্রমে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক যে সংখ্যাটি জানানো হয়েছিল, তা পরবর্তী তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
এ ছাড়া বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় সংঘটিত কিছু সহিংস ঘটনায় অস্ত্রধারী স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পরে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই সময়কার সহিংসতায় জড়িত অভিযোগে পরিচিত কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীর হত্যাকাণ্ডসহ পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনাও সে সময় হয়। এসব দাবির সত্যতা সম্পর্কে সরকারি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো স্বতন্ত্র যাচাই সে সময়ে পাওয়া যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালের পরবর্তী বছরগুলোতেও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাবলি নিয়ে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ অব্যাহত ছিল, যা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে। তাঁর মতে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো বা আক্রমণের অভিযোগ বহু সময় সামনে এসেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এসব ঘটনার প্রভাব হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নির্বাচনী পরিবেশ দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মুখে পড়ে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিবৃতিতে পুনরায় উল্লেখ করা হয় যে, শাপলা চত্বরে সংঘটিত ঘটনাবলি ও পরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় হওয়া সংঘর্ষ নিয়ে তখনকার সরকারি বিবৃতি, গণমাধ্যমের মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদক এবং হাসপাতাল-ভিত্তিক তথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্য পরবর্তীতে মানবাধিকার বিষয়ক কিছু সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গেও আলোচনায় আসে, যাদের মতে ঘটনাটি আরও বিস্তৃত তদন্তের দাবি রাখে।
তিনি মনে করেন, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরকেন্দ্রিক ঘটনাবলি এবং তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত, কারণ এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেশীয় রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে ছাপ রেখে গেছে। তাঁর প্রকাশিত বিবৃতিতে ঘটনাবলির পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও পরোক্ষভাবে উঠে আসে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর নীতি প্রণয়ন সম্ভব হয়।


