অর্থনীতি ডেস্ক
রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ছাড়া ধারনির্ভর উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয় উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগহের সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য। বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়ে জাতীয় ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বহন করতে সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের ওপর নির্ভর করছে। তার মতে, এ ধরনের নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তিনি বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রমকে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর রাখতে হলে স্থানীয় সম্পদ আহরণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। স্থানীয় কর-ভ্যাট ব্যবস্থাকে আধুনিক ও সক্ষম করে তুলতে পারলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থায়িত্ব আরও সুদৃঢ় হবে।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট ও কর আদায়ের পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। করদাতাদের থেকে সংগৃহীত রাজস্ব যেন কোনোভাবেই অপচয় বা অনিয়মের শিকার না হয়, সে বিষয়ে কর প্রশাসনকে কঠোর নজরদারি বজায় রাখতে হবে। স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে করদাতাদের আস্থা বাড়বে এবং কর প্রদানের মানসিকতা আরও বিস্তৃত হবে। তার মতে, রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কর আদায় প্রক্রিয়া সহজ, দ্রুত ও নির্ভুল হয়।
সেমিনারে দেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। বর্তমানে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ৬ দশমিক ৬ থেকে ৭ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে, যা দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নয়ন ব্যয় বাড়তে থাকলেও রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় দেশীয় অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাধা তৈরি হচ্ছে। তারা বলেন, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১২ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হলে উন্নয়ন ব্যয়ের বিপুল অংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পূরণ করা সম্ভব হবে।
অর্থ উপদেষ্টা জানান, ব্যক্তিসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর প্রদানকে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, কর পরিশোধ শুধু সরকারের অর্থসংস্থান নয়, বরং আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার একটি অপরিহার্য উপাদান। কর প্রদানের সংস্কৃতি যত বিস্তৃত হবে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ও সক্ষমতাও তত বাড়বে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, কেবল ভ্যাটের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। তিনি আয়করের ভিত্তি সম্প্রসারণ, নতুন করদাতা অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি, কর ফাঁকি রোধ এবং কর প্রশাসনের সক্ষমতা উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাজস্ব কাঠামো গঠন করতে হলে প্রত্যক্ষ করের অংশ বাড়াতে হবে। এতে আয়বৈষম্য কমার পাশাপাশি রাজস্ব প্রবাহও অধিকতর স্থায়ী হবে।
সেমিনারে অংশগ্রহণকারী অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও কর কর্মকর্তারা বলেন, দেশে বিপুল সংখ্যক সম্ভাব্য করদাতা এখনও রাজস্ব নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে। ব্যবসায়িক খাতসহ সেবা, কৃষি ও শিল্পে নতুন করদাতা শনাক্তকরণ কার্যক্রম জোরদার করলে রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে। এছাড়া ভ্যাট ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়তা বাড়ানো গেলে জাল চালান তৈরিসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি কমে আসবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, ভ্যাট সপ্তাহ উপলক্ষে সারাদেশে ভ্যাট বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ব্যবসায়ীদের তথ্য প্রদান, নতুন নিবন্ধন গ্রহণ ও করদাতাদের সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদের মতে, স্বয়ংক্রিয় ভ্যাট ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আহরণ আরও নিয়মতান্ত্রিক হবে এবং করদাতা ও প্রশাসনের মধ্যকার যোগাযোগে স্বচ্ছতা বাড়বে।
সেমিনারে অর্থনীতি বিশ্লেষক, কর কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তারা বলেন, একটি স্থিতিশীল রাজস্ব কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হলে কর প্রশাসনের সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করা, কর নীতি ও আইন আধুনিকায়ন এবং করদাতাদের সুবিধাবৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অংশগ্রহণকারীদের মতে, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশের আর্থিক ভিত্তি আরও দৃঢ় হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।


