ঢাকার বায়ুমান আবারও ‘অস্বাস্থ্যকর’, বিশ্বব্যাপী দূষণের তালিকায় অবস্থান সপ্তম

ঢাকার বায়ুমান আবারও ‘অস্বাস্থ্যকর’, বিশ্বব্যাপী দূষণের তালিকায় অবস্থান সপ্তম

 

জাতীয় ডেস্ক

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুর ১টা ২০ মিনিটে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বায়ুমান সূচকের আপডেট অনুযায়ী ঢাকার একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) মান দাঁড়িয়েছে ১৯৬, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হয়। একই সময়ে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান সপ্তম, যা চলতি মৌসুমে রাজধানীর বায়ুদূষণের তীব্রতা আবারও স্পষ্ট করে তুলেছে।

ঢাকার সামগ্রিক বায়ুমান দীর্ঘদিন ধরেই শীত মৌসুমে অবনতি ঘটছে। বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীতে ধুলো, যানবাহনের নির্গমন, নির্মাণকাজ থেকে উড়ন্ত বালুকণা এবং শীতকালে বাতাসের স্থবিরতার মতো কারণগুলো দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এসব কারণে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে একিউআই সাধারণত ১৫০-এর ওপরে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আইকিউএয়ারের মানদণ্ডে ১৫১–২০০ স্কোর ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ, যেখানে অ্যালার্জি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট বা হৃদরোগে ভোগা ব্যক্তিদের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।

বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষিত শহরের তালিকায় বৃহস্পতিবার শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর, যার একিউআই স্কোর ৪৬৫—যা ‘দুর্যোগপূর্ণ’ শ্রেণিভুক্ত। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মিশরের কায়রো ৩৪৪ স্কোর নিয়ে। তৃতীয় স্থানে ভারতের দিল্লি (২৫১), চতুর্থ স্থানে ভিয়েতনামের হ্যানয় (২২৮), পঞ্চম স্থানে ভারতের কলকাতা (২২১) এবং ষষ্ঠ স্থানে পাকিস্তানের করাচি (২১১)। সপ্তম স্থানে থাকা ঢাকার একিউআই ১৯৬ তুলনামূলকভাবে কম হলেও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি বহন করে। এরপর চীনের উহান ১৮৭, চেংদু ১৮১ এবং সাংহাই ১৭২ স্কোর নিয়ে তালিকার পরবর্তী অবস্থানগুলো দখল করেছে।

একিউআই বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বায়ুর দূষণমাত্রা পরিমাপের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সূচক। এতে মূলত পিএম–২.৫ এবং পিএম–১০ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, ওজোন, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইডের ঘনত্ব বিশ্লেষণ করে বায়ুমানের একটি সম্মিলিত সূচক নির্ধারণ করা হয়। আইকিউএয়ারের মানদণ্ডে ০–৫০ স্কোর ‘ভালো’, ৫১–১০০ ‘সহনীয়’, ১০১–১৫০ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ’, ১৫১–২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১–৩০০ ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-এর বেশি স্কোর ‘দুর্যোগপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। পিএম–২.৫ কণার উচ্চমাত্রা মানুষের শ্বাসতন্ত্রে গভীরভাবে প্রবেশ করতে পারে, যা ফুসফুস ও হৃদ্‌যন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বাড়ায়।

ঢাকায় শীতকালে দূষণ বৃদ্ধির পেছনে মৌসুমি কারণও উল্লেখযোগ্য। এ সময় তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ধুলিকণার উড্ডয়ন কম হলেও বাতাসের আর্দ্রতা ও স্থবিরতা কণাগুলোকে নিচের স্তরে আটকে রাখে। পাশাপাশি অসংখ্য নির্মাণসাইটে নিয়ন্ত্রণহীন বালুকণা উড়ে বেড়ানো, পুরনো যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পকারখানার নির্গমন এবং খোলা জায়গায় বর্জ্য বা পাতা পোড়ানোর মতো কর্মকাণ্ডও বায়ুমানের অবনতিতে ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুকনো মৌসুমে ঢাকার পিএম–২.৫ ঘনত্ব অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, দীর্ঘ সময় উচ্চমাত্রার দূষণে থাকলে শিশুদের ফুসফুসের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বয়স্ক এবং পূর্ববর্তী অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিদের হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ ও ফুসফুস সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি দূষণ কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং মানসিক চাপ বাড়ায়।

দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার উদ্যোগ থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকার বায়ুদূষণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হলে যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণসাইটে ধুলাবিচ্ছেদ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ইটভাটা নিশ্চিত করা, শিল্পকারখানার চিমনি ও বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা এবং নগর পরিকল্পনায় সবুজায়ন বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং একিউআই–ভিত্তিক সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে শীত মৌসুম জুড়ে ঢাকার বায়ুমান নিম্ন বা অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নাগরিকদের বাইরে বের হলে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় সময় বাইরে অবস্থান কমানো এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। একই সঙ্গে পরিবেশগত নীতি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বিত ও টেকসই উদ্যোগই দূষণ কমাতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ