বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি কমছে, সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি কমছে, সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার

অর্থনীতি ডেস্ক

৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। নতুন সরকারের অধীনে বৈদেশিক কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের বিষয়ে প্রত্যাশা তৈরি হলেও গত এক বছরে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য উদ্বেগজনক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ কর্মী গেছেন মাত্র পাঁচটি দেশে—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯০ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জনশক্তি রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

চলতি বছরের শুরুতেও এই নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৯৭ হাজার ৮৭৩ জন কর্মী বিদেশে গেলেও ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৪৪২ জনে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পাওয়া পরিস্থিতির আরও অবনতির ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া বা সীমিত হয়ে পড়াকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মালয়েশিয়া, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারে নিয়োগ কার্যক্রম কমে যাওয়ায় বিদেশে কর্মী পাঠানো ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি সৌদি আরব ও কাতারেও আগের তুলনায় নিয়োগের হার কমেছে। মালয়েশিয়া, ওমান এবং বাহরাইনের শ্রমবাজার দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরভাবে বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ওমানে সোয়া লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী গেলেও ২০২৪ সালে সেখানে মাত্র ৩৫৮ জন কর্মী যেতে পেরেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০২৩ সালে প্রায় এক লাখ কর্মী গেলেও ২০২৪ সালে সংখ্যা নেমে আসে ৪৭ হাজারে। বাহরাইনে ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে এবং ২০২৪ সালেও দেশটিতে কোনো কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী পাঠানোর হার তুলনামূলকভাবে কম। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ভাষাগত দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক কর্মী সেখানে যেতে পারছেন না। দক্ষিণ কোরিয়া ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দিলেও সে বছর পাঠানো গেছে মাত্র ৪ হাজার ৪৯৬ জন। ২০২৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে গেছেন ২ হাজার ৯১৮ জন।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাস্তবে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তার মতে, শ্রমবাজারের এই সংকীর্ণতা বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে, কারণ কোনো একটি দেশ নীতি পরিবর্তন করলে বা শ্রমবাজার বন্ধ করলে সামগ্রিক জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিদেশে যাওয়া মোট কর্মীর প্রায় ৮৯ শতাংশই গেছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। অথচ এসব প্রধান বাজারেও নিয়োগের গতি ধীর হয়ে আসছে। নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মী নিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। সৌদি আরবেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিপুলসংখ্যক কর্মী যাওয়ার ফলে চাহিদা কমেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং দক্ষ জনবল তৈরিতে সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকোচনের একটি বড় কারণ। পাশাপাশি রিক্রুটিং প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের অভিযোগও বিদেশি নিয়োগকারীদের আস্থাকে প্রভাবিত করছে। এসব কারণে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি এবং বিদ্যমান বাজারগুলো পুনরুজ্জীবনে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বহুমুখীকরণ, দক্ষ শ্রমিক তৈরি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী দিনে রেমিট্যান্স ও কর্মসংস্থানের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ