জেলা প্রতিনিধি
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতার কারণে সাড়ে সাত লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর সংকটে রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নদীপথ হলেও, রোগী পরিবহনের জন্য বরাদ্দকৃত দুটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় পড়ে থাকায় ঝুঁকি আরও বেড়েছে। চালক সংকট, জ্বালানি সরবরাহের অনিয়ম এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ না থাকায় কোটি টাকা ব্যয়ে সংগৃহীত নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দুটি বর্তমানে কার্যত অকার্যকর।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা হাতিয়া একটি নদীবেষ্টিত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উপজেলা। এই উপজেলায় প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের বসবাস। এখানকার প্রধান সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হলো ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের সংকট থাকায় জটিল রোগী, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং গুরুতর অসুস্থ শিশুদের নিয়মিতভাবে নোয়াখালী সদরসহ দেশের বিভিন্ন উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্রে স্থানান্তর করতে হয়।
উন্নত সড়ক যোগাযোগ না থাকায় এসব রোগীকে মেঘনা নদী পার হতে হয়। উত্তাল নদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট কাঠের নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলারে করে রোগী পরিবহন করা হয়, যা প্রায়ই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, নৌযাত্রার সময় নদীর ঢেউ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় মাঝনদীতে কিংবা নৌকায় ওঠানামার সময় রোগীর মৃত্যু ঘটার ঘটনাও রয়েছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় যাতায়াত আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, ফলে জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এই ভোগান্তি লাঘবের উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে এবং ২০২২ সালে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)-এর সহায়তায় রোগী পরিবহনের জন্য দুটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ দেওয়া হয়। শুরুতে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দুটি সীমিত পরিসরে সেবা দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো অচল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে, কোথাও মরিচা ধরেছে, আবার কোথাও যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে চালক না থাকা, জ্বালানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দের অভাবে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দুটি নদীর তীরে পড়ে আছে। ফলে সেগুলো জরুরি রোগী পরিবহনে কোনো কাজে আসছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নৌ-অ্যাম্বুলেন্স থাকা সত্ত্বেও তারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না এবং আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ নৌযানে করে রোগী নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নৌ-অ্যাম্বুলেন্স সচল রাখতে জনবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি। হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মানসী রানী সরকার বলেন, নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের কিছু যান্ত্রিক সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে পাখা ও অন্যান্য অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারণেই এসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন।
স্থানীয়দের দাবি, উপকূলীয় এই দ্বীপ উপজেলায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দুটি দ্রুত সংস্কার করে চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে চালক নিয়োগ, নিয়মিত জ্বালানি সরবরাহ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা বরাদ্দ নিশ্চিত করা হলে জরুরি রোগী পরিবহন অনেকটাই নিরাপদ ও কার্যকর হবে। এতে করে নদীপথে ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত কমে আসবে এবং সময়মতো উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


