প্রেস রিলিজ
স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ১শতাংশ বরাদ্দ, অপ্রতুল অবকাঠমো ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা, দক্ষ মানবম্পদের ঘাটতি, সেবা প্রাপ্তিতে উচ্চ ব্যয়, ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, বিদ্যমান নীতিমালার তদারকির অভাবের কারণে দেশের স্বাস্থ্যখাতে কাঙ্খিত উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়নি। তাই এখাতের সামগ্রিক উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি জনগনের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির উপর জোরারোপ করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত “বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতে আস্থা বৃদ্ধি; মান নিয়ন্ত্রণে কৌশলগত কাঠামো নিশ্চিতকরণ” শীর্ষক সেমিনার আলোচকবৃন্দ। উল্লেখ্য, অদ্য ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে ডিসিসিআই আয়োজিত এ সেমিনারে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি-এর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দেশে মানসম্মত ও রোগীবান্ধব সেবা নিশ্চিতে এখনও কাঠামোগত ঘাটতি রয়ে গেছে, এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্য সেবা মানের অসমতা, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের ঘাটতি, অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ফার্মেসির সম্প্রসারণ, ভুল ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট, ভুয়া ওষুধ ও তদারকি দুর্বলতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি বিদ্যমান আইনে বাস্তবায়নে উদাসীনতা আমাদের জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং আস্থাকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবহার না থাকার কারণে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭৪% ব্যক্তিকে নিজস্ব ব্যয়ে বহন করতে হয়, যা নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিকভাবে বড় ঝুঁকিতে পড়ে থাকেন। এমতাবস্থায় দেশে একটি টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সামগ্রিক এখাতে বিদেশী বিনিয়োগ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব জোরদার, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি, নার্সিং, ল্যাব সায়েন্স ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল উন্নয়ন, সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রয়োগ অপরিহার্য বলে মনে করেন, তাসকীন আহমেদ। পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে একটি শক্তিশালী হেলথ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলার উপর জোরারোপ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি-এর সভাপতি এ কে আজাদ খান বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য সেবায় বেশ অর্জন রয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে কাঙ্খিত মান নিশ্চিতের করা যায়নি, এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নতন দেশগুলোর মত নয়, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের পক্ষে ইউনিভার্সেল স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তবে আমাদেরকে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের উপর বেশি হারে জোর দিতে হবে। এখাতের ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণের কোন বিকল্প নেই বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন। তিনি আরো বলেন, ডিজিটাল হেলথ কেয়ার কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যাায় স্বাস্থ্য সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব। সেই চিকিৎসা শিক্ষাক্রম আধুনিকায়নের পাশাপাশি এখাতে গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবশে নিশ্চিত করার উপর তিনি জোরারোপ করেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রতি বাৎসরিক ব্যয় ১০৭০ টাকা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে প্রায় ৪৯শতাংক জনগন গুনগত স্বাস্থ্য সেবা হতে বঞ্চিত, যদিও বর্তমানে এখাতের মোট বাজার প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০৩৩ সালে তা ২৩ বিলিয়ন্ েউন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বল্প বাজেট বরাদ্দ ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, শহর-গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য, সেবার মান ও আস্থার ঘাটতি, দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট, ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়, অপ্রতুল অবকাঠামো এবং নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার দুর্বলতা এখাতের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে তিনি মত প্রকাশ করেন। তুলনামূলকভাবে ভালো স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে জনগনের একটি বড় অংশ অন্যান্য দেশে চিকিৎসা নিচ্ছে এবং এ বাবদ প্রতিবছর প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে। বিদ্যমান অবস্থার উন্নয়নে এখাতে স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষন ও ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকর, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং বিদ্যমান নীতিমালার যুগোপযোগীকরণে উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও তিনি বিদেশী দক্ষ টেকনিশিয়ান, নার্স এনে দেশীয় মানবসম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান নীতিতে প্রতিবন্ধকতা নিরসনের পাশাপাশি এখাতে লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে ওয়ান-স্টপ সেবা প্রবর্তনের আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় গ্রীণ লাইফ সেন্টারের চীফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি-এর স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের ডিন অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার মিত্র, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাফিউন নাহিন শিমুল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ’র সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মো. জাকির হোসেন, আইসিডিডিআরবি-এর সংক্রামক রোগ বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ-এর ম্যানেজার (পলিসি অ্যাডভোকেসি) ডা. মুশারাত জাহান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর হেলথ সিস্টেমস স্পেশালিস্ট ডা. ফিদা মেহরান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), বাংলাদেশ-এর ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (রোগী নিরাপত্তা ও রক্ত নিরাপত্তা) ডা. মুরাদ সুলতান অংশগ্রহণ করেন।
গ্রীণ লাইফ সেন্টার চীফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, যেহেতু দেশের বেশিরভাগ লোকই সরকারী খাতের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে, তাই সরকারি হাসপাতালগুলোতে সর্বোত্তম মান উন্নয়ন ও নিশ্চিতের কোন বিকল্প নেই। এখাতের সকল স্তরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, দেশীয় স্বাস্থ্যখাতের বাজার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এখাতের আস্থা ফিরাতে সরকারি-বেসরকারিখাত ও জনগনকে একযোগে কাজ করতে হবে, পাশাপাশি এখাতে পিপিপি মডেলের ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। তিনি জানান, আমাদের চিকিৎসা শিক্ষায় অংশ নেওয়া বিদেশী শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেন, যদিও কাঙ্খিত চিকিৎসা প্রাপ্তি অসংখ্য বাংলাদেশী অন্যান্য দেশে সেবা নিয়ে থাকেন, তাই বিষয়টি নিয়ে সচেতনভাবে চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, স্বাস্থ্য খাতের আস্থা বাড়াতে সেবা প্রদানকারীদের সাথে রোগীদের যোগাযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য বিষয়ক নেতিবাচক সংবাদ পরিহার এবং সর্বোপরি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার উপর জোরারোপ করা প্রয়োজন।
ডা. মোঃ জাকির হোসেন বলেন, প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার কারণে বাংলাদেশের ৯৭% ঔষধ স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত হচেছ এবং ১৬০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, তার মানে হলো আমাদের উৎপাদিত ঔষধের উপর আস্থা রয়েছে, তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ সালে হলেও গত ১৪ বছরেও তা যুগোপযোগী করা এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যখাতের কোন সমন্বিত নীতিমালা নেই। তাই এখাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী টেকসই নীতিমালার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বয় একান্ত অপরিহার্য, সেই সাথে স্বাস্থ্যখাতের অর্থায়ন স্ট্রাটেজি একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আইসিডিডিআরবি হতে প্রতিবছর প্রায় তিনলক্ষ রোগী ডায়েরীয়া সেবা নিচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের জন্য আইসিডিডিআরবি-এর মডেলে অন্যান্য জায়গায় অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, গত অক্টোবর হতে তার প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সার ডায়াগনস্টিক জেনেমিক্স নিয়ে কাজ করছে। ডেঙ্গি ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে এবং আগামী ২ বছরের মধ্যে এ রোগের ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ডা. ফিদা মেহরান সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বয়ের কোন বিকল্প নেই বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন।
ডা. মুরাদ সুলতান বলেন, সর্বপ্রথম দেশীয় স্বাস্থ্য সেবা আস্থা আনায়ন জরুরী, সেই সাথে বিদ্যমান স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া সংশোধনের কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি যথাযথ নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি হায়দার আহমদ খান, এফসিএ, প্রাক্তন পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ সারফুদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বিল্লাল হোসেন এবং মেগাহেলথ কোয়ারের সত্ত্বাধিকারী ইশতিয়াক আহমেদ বক্তব্য রাখেন।
ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মোঃ সালিম সোলায়মান সহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এবং সরকারি-বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।


