আরব বসন্ত: পাঁচ শাসকের পতনের ইতিহাস

আরব বসন্ত: পাঁচ শাসকের পতনের ইতিহাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২৬ বছর বয়সী তিউনিসীয় ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ বৌআজিজি পুলিশের হয়রানি ও রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতিবাদে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের গায়ে আগুন দেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিউনিসিয়ায় বেকারত্ব, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গণআন্দোলন শুরু হয়, যা ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিতি লাভ করে। মাত্র ২৮ দিনের আন্দোলনের পর তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট জিন এল আবিদিন বেন আলি ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত হন। এ ঘটনা পরবর্তী সময়ে মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলশ্রুতিতে পাঁচজন দীর্ঘদিনের শাসক ক্ষমতা হারান।

তিউনিসিয়ায় ১৯৮৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেন আলি হাবিব বুরগিবার শাসনকে অযোগ্য ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি নিরাপত্তা সংস্থা-নির্ভর শাসন, কঠোর দমননীতি ও অনুগত রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। অর্থনীতি কিছুটা উন্মুক্ত হলেও দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য ও গণমাধ্যম সেন্সরশিপ বৃদ্ধি পায়। বৌআজিজির আত্মাহুতির পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকার ভেঙে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। বেন আলি সৌদি আরবে পালিয়ে যান, যেখানে তিনি ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মারা যান।

মিশরে ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত হত্যার পর সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান হোসনি মোবারক রাষ্ট্রপতি হন। তিনি জরুরি আইন, সেনাবাহিনীর প্রভাব ও দমননীতির মাধ্যমে প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থাকেন। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশজুড়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ১৮ দিনের মধ্যে মোবারককে পদত্যাগে বাধ্য করে। আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল হয়। মোবারক কিছুদিন দুর্নীতির মামলায় আটক থাকলেও ২০১৭ সালে মুক্তি পান এবং ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কায়রোতে মারা যান।

ইয়েমেনে সাবেক প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ দীর্ঘদিন উত্তর ও একীভূত ইয়েমেন শাসন করেন। ২০১১ সালের আন্দোলনের পর ২০১২ সালে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজধানী সানা দখলে সহায়তা করেন। ২০১৭ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সমঝোতার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হুথিদের হাতে নিহত হন।

লিবিয়ায় ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থান করে রাজতন্ত্র উৎখাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মুআমার গাদ্দাফি। তিনি তেলসম্পদভিত্তিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেনগাজিতে মানবাধিকারকর্মী গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়, যা দ্রুত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। ন্যাটো অভিযানের সহায়তায় বিদ্রোহীরা আগস্টে ত্রিপোলি দখল করে এবং অক্টোবরের ২০ তারিখ নিজ শহর সির্তে পালানোর সময় ধরা পড়ে ও নিহত হন গাদ্দাফি।

সিরিয়ায় ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর বাশার আল-আসাদ রাষ্ট্রপতি হন। ২০১১ সালে দেরা শহরে স্কুলের দেয়ালে সরকারবিরোধী গ্রাফিতি লেখা কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়, যা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা যুদ্ধে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের আকস্মিক অভিযানে সিরীয় সেনাবাহিনী ভেঙে পড়ে। দামেস্কে বিদ্রোহীরা ঢোকার পর বাশার আল-আসাদ পরিবারসহ রাশিয়ার মস্কোতে পালিয়ে যান।

আরব বসন্তের এই আন্দোলনগুলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি শাসকগোষ্ঠীর পতন, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসাধারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সমাজে নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের উদ্ভব এই অঞ্চলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি সংক্রান্ত বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট প্রদান করে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ