জেলা প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে এই মহাসড়কে সংঘটিত ৬৫টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৯৮ জন নিহত এবং ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। ১৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের হাজারো মানুষ চলাচল করলেও সড়কটির অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি ক্রমেই বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, পটিয়া, বাঁশখালী, বান্দরবান, চকরিয়া ও কক্সবাজার জেলার মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম এই মহাসড়ক। পর্যটন, বাণিজ্য, চিকিৎসা ও কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দীর্ঘদিন ধরে মহাসড়কটির বড় অংশ অপ্রশস্ত অবস্থায় রয়েছে। অধিকাংশ স্থানে সড়কের প্রস্থ ১৮ থেকে ২২ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং কার্যকর কোনো বিভাজক নেই। ফলে বিপরীতমুখী যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ছে।
সড়কটির বিভিন্ন অংশে রয়েছে তীক্ষ্ণ বাঁক, অপর্যাপ্ত সাইনেজ ও অস্পষ্ট রোড মার্কিং। অনেক এলাকায় রাতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় দৃশ্যমানতা কমে যায়। এসব কারণে চালকের সামান্য অসতর্কতাই বড় দুর্ঘটনার রূপ নিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত দুর্ঘটনার বড় অংশই মুখোমুখি সংঘর্ষ ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনার আগে বেপরোয়া গতি, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং এবং কখনো কখনো উল্টো পথে চলাচলের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক সড়ক নিরাপত্তা চিত্রের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছায় এবং আহত হন আরও বহু মানুষ। ওই বছরে গাড়িচাপা, মুখোমুখি সংঘর্ষ, উল্টো পথে চলাচল ও যানবাহন খাদে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো প্রাণহানির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
সাম্প্রতিক সময়েও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে সারা দেশে ৫২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০৭ জন নিহত এবং ৮৯৯ জন আহত হন। একই সময়ে রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় আরও প্রাণহানি ঘটে। ওই মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এক মাসে প্রায় দুই শতাধিক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়, যা মোট নিহতের একটি বড় অংশ। নিহতদের মধ্যে চালক, পথচারী, নারী, শিশু, শিক্ষার্থী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও ছিলেন।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে অবৈধ ও ধীরগতির যানবাহনের চলাচলও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অনেক ভ্যান, ইজিবাইক ও অটোরিকশার নিবন্ধন নেই, নেই প্রয়োজনীয় হেডলাইট বা রিফ্লেক্টর। আইন অনুযায়ী এসব যানবাহনের মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি না থাকলেও বাস্তবে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
দুর্ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা দায়ের হলেও তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। চালকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও পরিবহন মালিক বা কোম্পানির দায় নির্ধারণের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকে। ফলে একই পরিবহন প্রতিষ্ঠানের যানবাহন বারবার ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করেও কার্যকর জবাবদিহির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষকের মতে, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক মূলত দুই লেনের হওয়ায় এবং বিভাজক না থাকায় ঝুঁকি বেশি। দুই পাশে গাছ ও বাঁকের কারণে দৃশ্যমানতা কমে যায়। পাশাপাশি অবৈধ থ্রি-হুইলার ও সড়কের পাশে হাটবাজার থাকায় পথচারী পারাপারও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সড়ক প্রশস্তকরণ, বিভাজক স্থাপন এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সংস্কার করা গেলে দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রাইভেট কার ও বাসের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেলের জন্য ৬০ কিলোমিটার এবং পণ্যবাহী যানবাহনের জন্য ৫০ কিলোমিটার নির্ধারিত। তবে বাস্তবে এসব সীমা মানা হচ্ছে না বলে হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানার এক কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, বেপরোয়া গতি ও ট্রাফিক নির্দেশনা না মানার প্রবণতাই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তার দাবিতে সম্প্রতি লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও চকরিয়া এলাকায় স্থানীয়রা মহাসড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে মহাসড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণের দাবি জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, ফিটনেস ও রুট পারমিট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, চালকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন মালিকপক্ষের দায় নিশ্চিতকরণ এবং আইন প্রয়োগ—এই সবকিছুর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।


