শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পানির উৎস ও স্যানিটেশন সুবিধায় থাকলেও মৌলিক সেবায় ঘাটতি রয়ে গেছে: বিবিএস জরিপ

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পানির উৎস ও স্যানিটেশন সুবিধায় থাকলেও মৌলিক সেবায় ঘাটতি রয়ে গেছে: বিবিএস জরিপ

নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উন্নত পানির উৎসের সুবিধা থাকলেও মৌলিক পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি সেবার ক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘ওয়াশ ইন এডুকেশন অ্যান্ড হেলথকেয়ার ফ্যাসিলিটিজ সার্ভে ২০২৪’-এর ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৯৫.৪ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ৮৭.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উন্নত পানির উৎসের সুবিধা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘বেসিক ওয়াটার সার্ভিস’ মানদণ্ড অনুযায়ী—যেখানে উন্নত পানির উৎসটি অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের সীমানার ভেতরে থাকতে হবে—সে হিসেবে এই হার কমে যায়। এ মানদণ্ড পূরণ করে ৮৬.১ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ৭০.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। এতে বোঝা যায়, পানির উৎস থাকলেও তা সব ক্ষেত্রে নিরাপদ, সহজপ্রাপ্য ও নিয়মিত ব্যবহারের উপযোগী নয়।

বিবিএস জানায়, জরিপে দেশের আটটি বিভাগ ও ৬৪টি জেলার সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতাসহ বিভিন্ন সূচক মূল্যায়ন করা হয়।

স্যানিটেশন সুবিধার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৯০.৬ শতাংশ বিদ্যালয় এবং ৯৮.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অন্তত একটি শৌচাগার রয়েছে। তবে এসব শৌচাগারের গুণগত মান, পর্যাপ্ততা এবং নিয়মিত ব্যবহারের উপযোগিতায় বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে শৌচাগার থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয় বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

হাত ধোয়ার সুবিধা নিয়েও জরিপে সীমাবদ্ধতার চিত্র উঠে এসেছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে হাত ধোয়ার স্থান থাকলেও অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত পানি ও সাবানের অভাব রয়েছে। ফলে মাত্র ৫১.৭ শতাংশ বিদ্যালয় এবং মাত্র ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ‘বেসিক হ্যান্ডওয়াশিং’ সেবার মানদণ্ড পূরণ করতে পেরেছে। এ পরিস্থিতি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিশোরী মেয়েদের জন্য স্যানিটেশন ও মাসিক স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। মাত্র ২০.৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে কিশোরী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার রয়েছে এবং মাত্র ৬.৯ শতাংশ বিদ্যালয় মৌলিক মাসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। এই সীমাবদ্ধতা শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি বৃদ্ধি, অস্বস্তি এবং শিক্ষায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বাড়াতে পারে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে বড় পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। ৭৮.৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে কঠিন বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা থাকলেও মাত্র ২৫.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মৌলিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয়। জরিপে আরও দেখা যায়, ৪১.৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ায়, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবও জরিপে উঠে এসেছে। গত ১২ মাসে ২৪.০ শতাংশ বিদ্যালয় এবং ১৯.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘটনায় পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামোর সরাসরি ক্ষতি হয়েছে, যা সেবা প্রদানে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী পানির উৎস রয়েছে ৫৫.৪ শতাংশ বিদ্যালয়ে এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এই হার মাত্র ৪০.৯ শতাংশ। এতে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও সমান সেবা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট হয়।

আর্থিক সক্ষমতার দিক থেকে জরিপে দেখা যায়, মাত্র ১১.১ শতাংশ বিদ্যালয় এবং ৩৪.৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ‘ওয়াশ’ খাতের জন্য নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব টেকসই পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উন্নত পরিকল্পনা এবং জলবায়ু-সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ওয়াশ ব্যবস্থার ওপর জোর না দিলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে মৌলিক পানি ও স্যানিটেশন সেবার ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ