জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ড মামলার রায় ২০ জানুয়ারি

জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ড মামলার রায় ২০ জানুয়ারি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫—জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিচারিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ আগামী ২০ জানুয়ারি এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন। এটি জুলাই–আগস্ট গণআন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায় হতে যাচ্ছে।

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদালতের কার্যতালিকা অনুযায়ী, যুক্তিতর্ক পর্ব শেষ হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে আদেশ প্রদান করেন।

মামলার নথি ও ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, আলোচ্য মামলার আট আসামির মধ্যে চারজন বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। পলাতক আসামিরা হলেন—ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, একই অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল এবং ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। অপরদিকে, ট্রাইব্যুনালের আদেশে গ্রেপ্তার হয়ে হেফাজতে থাকা চার আসামি হলেন—শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, মো. ইমাজ হোসেন এবং মো. নাসিরুল ইসলাম। মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

শুনানি পর্বে আসামি ইমাজ হোসেনের পক্ষে তার আইনজীবী মো. জিয়াউর রশিদ চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। পলাতক চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুব উদ্দিন আদালতে যুক্তিতর্ক প্রদান করেন। প্রসিকিউশন পক্ষে চূড়ান্ত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। যুক্তিতর্কে প্রসিকিউশন দাবি করেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা প্রয়োজন। অপরদিকে, আসামিপক্ষ যুক্তিতর্কে দাবি করেন যে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং উপস্থাপিত সাক্ষ্য–প্রমাণ অভিযোগকে সমর্থন করে না; ফলে সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া উচিত।

তদন্তের কালানুক্রমে দেখা যায়, গত বছর ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে ছয় আন্দোলনকারী নিহত হন। নিহতরা হলেন—শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক এবং মানিক মিয়া। ঘটনার পর অভিযোগ দাখিল হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ৬ মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে এবং ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এটিই ছিল জুলাই–আগস্ট গণআন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয় এবং ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। মামলায় মোট ৭৯ জনকে সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রসিকিউশন। ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।

১১ আগস্ট চিফ প্রসিকিউটরের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় এবং ওই দিন থেকেই সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব চালু হয়। ২৩ কার্যদিবসে মোট ২৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন দুইজন। ১৫ ডিসেম্বর থেকে প্রসিকিউশন যুক্তিতর্ক শুরু করেন, আর আসামিপক্ষ ২২ ডিসেম্বর থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সমাপ্ত হলে আদালত রায়ের তারিখ ঘোষণা করেন।

এদিকে, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি ওরফে ওসমান গণি (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ সংক্রান্ত পৃথক মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামতের ব্যালিস্টিক পরীক্ষার নির্দেশ প্রদান করেছেন। বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মোহাম্মদ জুনায়েদ এ আদেশ দেন। আদেশে সিআইডির ব্যালিস্টিক শাখার বিশেষ পুলিশ সুপারকে জব্দকৃত ফায়ার কার্তুজ এবং ফায়ার বুলেট সদৃশ বস্তু পরীক্ষা করে বিস্তারিত মতামত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মামলার তদন্ত আবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে পল্টন থানাধীন বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে ডিআর টাওয়ারের সামনে শরিফ ওসমান হাদি দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে আহত হন। তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুরে নিয়ে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে মরদেহ দেশে আনা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত ও ময়নাতদন্ত ২০ ডিসেম্বর সকালে সম্পন্ন হয়।

মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, হামলার সময় ওসমান হাদির পেছন থেকে মোটরসাইকেলে অনুসরণ করে আসা আসামি ফয়সাল করিম, মাসুদ, রাহুল, রাহুল দাউদসহ অজ্ঞাত সহযোগীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে পালিয়ে যান। ১৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদী হয়ে পল্টন থানায় প্রথমে হত্যাচেষ্টা (দণ্ডবিধির ১২০(বি), ৩২৬, ৩০৭, ১০৯, ৩৪) ধারায় মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২০ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্দিক আজাদ মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা) সংযোজনের নির্দেশ দেন।

আইন–বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্যালিস্টিক পরীক্ষার প্রতিবেদন এ মামলার তদন্ত ও অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে, জুলাই অভ্যুত্থানের ছয় হত্যার মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় জবাবদিহিতা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতির একটি দৃশ্যমান ধাপ সম্পন্ন হলো। মামলার রায়ে অভিযুক্তদের দায় ও শাস্তি নির্ধারণের পাশাপাশি বিচারিক পর্যবেক্ষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, জবাবদিহিতার কাঠামো এবং ভবিষ্যৎ অপরাধ প্রতিরোধে দিকনির্দেশনা উঠে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

আইন আদালত শীর্ষ সংবাদ