নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা, ২৬ ডিসেম্বর—সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শেষ মেয়াদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের শুল্ক-কর ছাড়ে আনা গাড়ি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিবহন পুলে নেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। নিলামে প্রত্যাশিত দর না ওঠা এবং গাড়িগুলো দীর্ঘদিন বন্দরের শেডে পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নিলামে পর্যাপ্ত দর না ওঠায় দ্বাদশ সংসদের ৩১ জন সদস্যের আমদানি করা ৩১টি গাড়ি সরকারি পরিবহন পুলে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বিশেষ কমিটির সুপারিশ, কাস্টমস ও বিআরটিএর যাচাই-বাছাই শেষে ৩০টি গাড়ি হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। এর আগে সংসদ সদস্যদের আমদানি করা গাড়ি এভাবে সরকারের কাছে নেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত না থাকায় বিষয়টি নিয়ে আইনি ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা তৈরি হয়েছিল। পরে যানবাহন অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে গাড়িগুলোর মালিকানা, খালাস, নিবন্ধন এবং ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১২ নভেম্বর প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মূল্যমানের বিলাসবহুল গাড়িগুলো শর্তসাপেক্ষে পরিবহন পুলে যুক্ত করার বিশেষ আদেশ জারি করে। আদেশে উল্লেখ করা হয়, ভবিষ্যতে সাবেক আমদানিকারক সংসদ সদস্যরা চাইলে নির্ধারিত শুল্ক-কর পরিশোধ সাপেক্ষে গাড়িগুলো পুনরায় নিজেদের দখলে নিতে পারবেন। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, শুল্ক-কর পরিশোধের সুযোগ রেখে মালিকানার চূড়ান্ত অধিকার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা বা আর্থিক বিরোধ এড়ানো সম্ভব হয়।
এরই মধ্যে যানবাহন অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম বন্দরে সংরক্ষিত গাড়িগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন, কারিগরি সক্ষমতা যাচাই, মূল্যায়ন, সংরক্ষণ অবস্থা এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন। সকল প্রক্রিয়া শেষে ৩০টি গাড়ির খালাস এবং হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার শরিফ আল আমিন বলেন, “গাড়ি খালাসের সকল প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জনপ্রশাসন ও পরিবহন পুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা গাড়িগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য বন্দরে উপস্থিত ছিলেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর গ্রহণ করেছেন।” তিনি আরও জানান, কাস্টমসের পক্ষ থেকে গাড়িগুলোর আমদানি-খালাসে যে সকল করছাড় সংক্রান্ত নথি এবং শর্তযুক্ত বিশেষ আদেশ জারি হয়েছিল, সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
গাড়ি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মতে, উচ্চমূল্য, বড় ইঞ্জিন ক্ষমতা এবং আমদানির প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে এসব গাড়ি নিলামে বিক্রি করা কঠিন ছিল। দীর্ঘদিন শেডে পড়ে থাকলে ইঞ্জিন, ইলেকট্রনিক সিস্টেম, চেসিস এবং বডি পার্টসের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়ত, যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হতো। সে কারণে সরকারি পরিবহন পুলে যুক্ত করা ছিল সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক সিদ্ধান্ত।
তবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির আইন সংস্কারের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)। সংগঠনটির নেতারা মনে করেন, ইঞ্জিন ক্ষমতার সীমা, জ্বালানি নীতিমালা এবং ব্যবহারের ধরন বিবেচনায় আইন আরও বাস্তবমুখী হওয়া প্রয়োজন।
বারভিডার সাবেক সহ-সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “সংসদ সদস্যদের জন্য গাড়ি বরাদ্দই যদি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, তবে ৩ হাজার সিসি পেট্রোল ইঞ্জিন কেন নির্ধারণ করা হবে? প্রয়োজন হলে অন্তত ৩,৫০০ সিসি পর্যন্ত পেট্রোল ইঞ্জিন অনুমোদনের সুযোগ রাখতে হবে। পাশাপাশি, গাড়ি ব্যবহারের একটি স্ল্যাব বা ক্যাটাগরি ভাগ করে দেওয়া দরকার, যাতে প্রান্তিক জেলা, দুর্গম এলাকা বা যেকোনো ভৌগোলিক বাস্তবতায় যান চলাচল সক্ষমতা বজায় থাকে।”
সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির নীতি প্রথম চালু হয় এরশাদ সরকারের শাসনামলে। দ্বাদশ সংসদের সময় এ সুবিধায় মোট ৫১টি গাড়ি আমদানি করা হয়, যার অধিকাংশই টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার মডেলের। সংসদ বিলুপ্তির পর আমদানিকৃত গাড়িগুলোর বেশিরভাগই খালাস হয়নি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ছিল। সবশেষ ৩০টি গাড়ি খালাস ও হস্তান্তর করা হলেও বাকি গাড়িগুলোর ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কমিটির পর্যবেক্ষণ চলমান রয়েছে।
নীতিবিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ঘটনা রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুরক্ষা, জনসেবায় ব্যবহারযোগ্যতা বৃদ্ধি এবং আমদানি নীতিমালায় ভবিষ্যৎ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। সরকারি পরিবহন পুলে যুক্ত হওয়া এসব গাড়ি এখন থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি পরিবহন, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরের জরুরি সেবা, উচ্চপর্যায়ের সফর এবং প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এ উদ্যোগ একদিকে যেমন বিপুল অর্থমূল্যের সম্পদ রক্ষা করেছে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ নীতিগত সংস্কারের আলোচনাকে আরও জোরালো করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে আমদানি-কর কাঠামো, ইঞ্জিন ক্ষমতা, ব্যবহার নীতি এবং করছাড়ের যৌক্তিকতা নিয়ে একটি সংস্কার প্রস্তাব প্রস্তুতের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।


