অ্যাশেজ টেস্টে পেসারদের তাণ্ডব

অ্যাশেজ টেস্টে পেসারদের তাণ্ডব


খেলাধুলা ডেস্ক

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) চলমান অ্যাশেজ টেস্টে পেসারদের অসাধারণ আধিপত্যে মাত্র দুই দিনেই ৩০ উইকেটের পতন ঘটেছে, যা টেস্ট ক্রিকেটের ১৩০ বছরের ইতিহাসে বিরলতম ঘটনাগুলোর একটি। প্রথম দিনেই ২০ উইকেট পড়ে ১৮৯৪ সালের পর প্রথমবারের মতো মেলবোর্নে এত দ্রুত উইকেট পতনের রেকর্ড ছোঁয়া হয়। শনিবার (দ্বিতীয় দিন) এই দাপট আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেয়, যেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর দ্বিতীয় সেশনে মাত্র ১০ ওভার ব্যাট করতে পেরেছে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডের তিন পেসারের গতি, সুইং ও নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থের সামনে অসি ব্যাটিং লাইনআপ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।

ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস ৩৪.৩ ওভারে মাত্র ১৩২ রানে থেমে যায়। প্রথম ইনিংসে ১৫২ রান করে অলআউট হওয়া অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে ১১০ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৪২ রানের লিড পেয়েছিল। এই লিড দ্বিতীয় ইনিংসের ১৩২ রানের সঙ্গে যোগ হয়ে স্বাগতিকদের মোট সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৭৪ রানে। তবে বলের হিসাবে এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং ছিল হতাশাজনক—গত ৩০ বছরে কোনো টেস্টে নিজেদের দুই ইনিংস মিলিয়ে সর্বনিম্ন ৪৭৯ বল (৪৭৯ deliveries) খেলতে পেরেছে তারা, যা ২০০০ সালের পর টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে তাদের তৃতীয় সর্বনিম্ন ২৮৪ রানের রেকর্ডও স্পর্শ করেছে।

পিচের আচরণ, আবহাওয়া ও ম্যাচ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এমসিজির উইকেটে গতি ও সুইংয়ের জন্য আদর্শ শর্ত তৈরি হয়েছে। প্রথম দিনে পেসাররা যেমন উইকেটের মুভমেন্ট কাজে লাগিয়ে দুই দলের ব্যাটারদের চাপে ফেলেছিল, দ্বিতীয় দিন সেই শর্ত আরও ধারালো হয়ে ওঠে। উইকেটে অতিরিক্ত বাউন্স না থাকলেও সুইং ও সিম মুভমেন্টের ধারাবাহিকতা এবং ১৩৫–১৪৫ কিমি গতির পেস আক্রমণ ব্যাটারদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের পেস আক্রমণের সমন্বিত কৌশল—শর্ট অব লেন্থ ডেলিভারি, করিডোর অব আনসার্টেনটিতে বল ফেলা এবং নতুন বলের রিভার্স সুইং কাজে লাগানো—অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিং বিপর্যয়ে ঠেলে দেয়।

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং ইনিংসের দিকে তাকালে কিছু ব্যক্তিগত লড়াই দেখা গেলেও, তা দলীয় ব্যর্থতাকে আড়াল করতে পারেনি। ট্রাভিস হেড ৬৭ বলে ৪টি চারের সাহায্যে সর্বোচ্চ ৪৬ রান করেন, যা অসি ইনিংসের একমাত্র আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টা। ক্যামেরন গ্রিনের ব্যাট থেকে আসে ১৯ রান। অন্যদিকে, স্টিভ স্মিথ ২৪ রানে অপরাজিত থেকে ব্যক্তিগত রানের মাইলফলকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অ্যাশেজ সিরিজে স্মিথের বর্তমান রান ৩৫৫৩, যেখানে কিংবদন্তি অ্যালান বোর্ডারের রেকর্ড ছুঁতে তার দরকার ছিল ২৯ রান, কিন্তু ৫ রানের ঘাটতি থেকেই ইনিংস শেষ হয়। এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মাত্র তিন ব্যাটার দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পেরেছেন, যা দলীয় ব্যাটিংয়ের ভঙ্গুর চিত্র তুলে ধরে।

ইংল্যান্ডের বোলিং ইউনিটে এই ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিন পেসারের সমন্বিত আক্রমণ। চোটের কারণে গাস অ্যাটকিনসন ৫ ওভারের বেশি বল করতে না পারলেও ১ উইকেট নেন। বাকি পেসাররা অস্ট্রেলিয়াকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন—ব্রাইডন কার্স সর্বোচ্চ ৪ উইকেট শিকার করেন, অধিনায়ক-অলরাউন্ডার বেন স্টোকস ৩ উইকেট, এবং জশ টাং ২ উইকেট তুলে নেন। জশ টাং ও কার্সের বলের গতি ছিল ধারাবাহিকভাবে ১৪০ কিমি’র ঘরে, যা এমসিজির ঠান্ডা সকালের বাতাসে সুইংকে আরও কার্যকর করেছে। স্টোকস নিজের অভিজ্ঞতা ও বলের মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণে রেখে মাঝের ওভারে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু এনে দেন।

ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ১১০ রানে অলআউট হলেও, তাদের বোলাররা ব্যাটিং ব্যর্থতার জবাব দিয়েছেন দাপুটে আক্রমণে। ২৯.৫ ওভারে ১১০ রানে থেমে যাওয়া ইংল্যান্ডের ইনিংসের পর ৪৫.২ ওভারে ১৫২ রান করে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়, যা পিচের বোলার-বান্ধব আচরণের প্রমাণ। এই ম্যাচে পেসারদের উইকেট নেওয়ার হার, ব্যাটারদের ইনিংস স্থায়িত্ব, এবং সেশনভিত্তিক বলের সংখ্যা—সবই দেখাচ্ছে, এটি এক যুগে পেসারদের অন্যতম প্রভাবশালী টেস্ট পারফরম্যান্স।

বিশ্লেষকদের মতে, ম্যাচের বাকি দিনগুলোতেও পেসারদের প্রভাব বজায় থাকতে পারে, তবে নতুন বলের আচরণ, ব্যাটিং পরিকল্পনা ও মানসিক দৃঢ়তা—এখান থেকেই ম্যাচের গতিপথ বদলাতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ—ইংল্যান্ডের ১৭৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করার জন্য প্রতিরোধী ব্যাটিং পরিকল্পনা তৈরি করা এবং পিচ-আবহাওয়া-নতুন বলের মুভমেন্টকে সামাল দেওয়া। অন্যদিকে, ইংল্যান্ডের লক্ষ্য থাকবে লিডকে ডিফেন্ড করে পেস আক্রমণ ধরে রেখে সিরিজে মানসিক ও কৌশলগত সুবিধা ধরে রাখা।

মেলবোর্নের এই অ্যাশেজ টেস্ট ইতোমধ্যেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে—পেসারদের আধিপত্য, ব্যাটিং বিপর্যয়, রেকর্ডের ছড়াছড়ি এবং নাটকীয় টেস্ট আবহে। এটি শুধু একটি ম্যাচ নয়, বরং টেস্ট ক্রিকেটে পেস বোলিংয়ের শৈল্পিক শক্তি ও ম্যাচ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের এক জীবন্ত প্রদর্শনী।

খেলাধূলা শীর্ষ সংবাদ