ঘন কুয়াশায় সারাদেশে নৌযান চলাচল বন্ধ

ঘন কুয়াশায় সারাদেশে নৌযান চলাচল বন্ধ

জেলা প্রতিনিধি

ঘন কুয়াশার কারণে সারাদেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ–পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত সাড়ে ১০টা থেকে কার্যকর হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে। সংস্থাটির চাঁদপুর অঞ্চলের উপপরিচালক (নৌ–নিট্রা) বাবু লাল বৈদ্য রাত ১১টার দিকে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতের দিকে নদীপথে কুয়াশার ঘনত্ব হঠাৎ বেড়ে যায়, যা নৌচলাচলের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। বিশেষ করে মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, কীর্তনখোলা ও তেঁতুলিয়া নদীর বিভিন্ন নৌরুটে দৃশ্যমানতা শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসে। এই পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা এড়াতে কেন্দ্রীয়ভাবে সারাদেশের নৌপথে সব ধরনের লঞ্চ, ফেরি, স্পিডবোট, ট্রলার, বাল্কহেড, কার্গোসহ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনকারী নৌযানের চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।

উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য বলেন, “রাতের দিকে নদীতে কুয়াশার ঘনত্ব অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় নৌচলাচল নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। তাই ঢাকা, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশালসহ সারাদেশের সব নৌরুটে রাত সাড়ে ১০টা থেকে নৌযান বন্ধ রাখা হয়েছে। চলমান লঞ্চগুলোকে যেখানে অবস্থান করছে, সেখানেই নিরাপদভাবে নদীর পাড়ে নোঙর করে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।” তিনি আরও জানান, কুয়াশা কেটে গেলে এবং আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নৌচলাচল পুনরায় চালু করা হবে।

বিআইডব্লিউটিএর নৌ–নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তারা জানান, কুয়াশার এই পরিস্থিতিতে রাতভর নদীতে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ জোরদার করা হয়েছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাট ও নৌ–রুটে নিয়োজিত নৌ–নিরাপত্তা কর্মীদের সতর্ক অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নদীতে নোঙর করা নৌযানগুলো যাতে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে না জড়ায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রেখে নোঙর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঘাট কর্তৃপক্ষ, নৌ–চালক ও স্টাফদের আবহাওয়া আপডেট নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে, এর আগের দিন বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলার হরিনা এলাকার মেঘনা নদীতে ঢাকাগামী দুইটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতা কম থাকায় সংঘর্ষটি ঘটে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। সংঘর্ষে জাকির সম্রাট–৩ ও অ্যাডভেঞ্চার–৯ লঞ্চ জড়িত ছিল। দুর্ঘটনায় চারজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। সংঘর্ষের সময় জাকির সম্রাট–৩ লঞ্চটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মাঝনদীতে ডুবো–ডুবো অবস্থায় ভাসতে থাকে। পরে নৌ–উদ্ধারকারী দল নদীতে ভাসমান অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চটি পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়।

দুর্ঘটনার পর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ শুক্রবার সকালে ঝালকাঠি লঞ্চঘাট থেকে অ্যাডভেঞ্চার–৯ লঞ্চটিকে জব্দ করে। একইসঙ্গে লঞ্চটির চারজন স্টাফকে জিজ্ঞাসাবাদ ও আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আটক করা হয়। নৌ–দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার কারণ, দায় নিরূপণ, নিরাপত্তা–ব্যবস্থার ত্রুটি এবং নৌচালকদের নেভিগেশন–পদ্ধতি বিশ্লেষণ শুরু করেছে। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কুয়াশা, গতি–নিয়ন্ত্রণ, রাডার–ব্যবহার, সিগন্যালিং–পদ্ধতি এবং নৌরুটে সতর্কতা মানা হয়েছে কি না—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নৌপথ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেশের প্রধান নদীগুলোতে ঘন কুয়াশা নৌচলাচলের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বারবার বিঘ্ন ঘটায়। প্রতি বছরই শীতের সময় যাত্রীবাহী লঞ্চ, ফেরি ও ছোট নৌযানের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে কুয়াশা–জনিত দৃশ্যমানতা হ্রাস, সিগন্যালিং–ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং আধুনিক নেভিগেশন–সহায়ক প্রযুক্তির অপ্রতুলতা চিহ্নিত করা হয়।

নৌ–নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শীত মৌসুমে কুয়াশা–জনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নৌযানে বাধ্যতামূলক রাডার–ব্যবহার, জিপিএস–নির্ভর নেভিগেশন–সিস্টেম উন্নয়ন, গতি–সীমা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, নদীপথে মার্কার বয়া ও আলোক–সংকেত আধুনিকীকরণ এবং চালক–স্টাফদের প্রযুক্তি–ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ আরও জোরদার করা প্রয়োজন। যদিও এসব মতামত নীতিগত বিশ্লেষণ, তবে চলমান পরিস্থিতিতে বিআইডব্লিউটিএর সিদ্ধান্ত দুর্ঘটনা–প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ও কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নৌচলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি যাত্রী ও নৌ–চালকদের নিরাপত্তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে যাত্রীদের ঘাটে অবস্থান, বিকল্প যাতায়াত–পরিকল্পনা ও নৌযান–স্টাফদের নিরাপত্তা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঘাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় অব্যাহত রয়েছে।

শীত মৌসুমে আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত নদীপথে নৌচলাচলের সিদ্ধান্ত পর্যায়ক্রমে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। কুয়াশা কেটে গেলে এবং নৌ–নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সবুজ সংকেত মিললে নৌযানগুলো নির্ধারিত রুটে চলাচল শুরু করবে।

শীর্ষ সংবাদ সারাদেশ