অর্থনীতি ডেস্ক
দেশের স্বর্ণবাজারে ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থেকে টানা সপ্তমবারের মতো দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনার মূল্য নতুন সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করেছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে সর্বশেষ মূল্য সমন্বয়ের ঘোষণা দেয়। সমন্বয় অনুযায়ী, ২২ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরিতে ১ হাজার ৫৭৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে নতুন দাম নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৬ টাকা। বাজুস জানিয়েছে, নতুন এ মূল্য রবিবার থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে।
বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে স্থানীয় বাজারে ‘তেজাবি সোনা’ বা পিওর গোল্ডের মূল্যবৃদ্ধিকে প্রধান প্রভাবক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্য অস্থিতিশীল থাকা, ডলার-টাকা বিনিময় হারে চাপ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং স্থানীয় পর্যায়ে পিওর গোল্ডের সরবরাহ-চাহিদা ভারসাম্যে ঘাটতি—এসব বিষয় সমন্বিতভাবে দেশীয় বাজারে স্বর্ণের দামে প্রভাব ফেলছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
চলতি বছরের শেষ প্রান্তে এসে স্বর্ণের এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ ক্রেতা ও জুয়েলারি শিল্পে বহুমুখী প্রভাব তৈরি করেছে। বিগত ছয় দফা সমন্বয়ের ধারাবাহিকতায় এবারও স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। গয়না কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে ১৮ ও ২১ ক্যারেটের দিকে ঝুঁকছিল; তবে এসব ক্যাটাগরিতেও নতুন সমন্বয়ে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজুস ঘোষিত নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী, ২১ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরি ২১ হাজার ৮৯৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে নতুন দাম নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৪ টাকা। ১৮ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরিতে ১৯ হাজার ৬৭৯ টাকা বেড়ে নতুন মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৪৯ টাকা। এছাড়া, সনাতন পদ্ধতির (অপ্রচলিত মান নির্ধারণ) সোনার প্রতি ভরিতে ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৩ টাকা।
দেশের স্বর্ণের বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে বৈধ চ্যানেলে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ থাকলেও আমদানিকারকদের ব্যয় নির্ভর করে আন্তর্জাতিক দর, পরিবহন খরচ, বীমা, শুল্ক, কর, ভ্যাট এবং সর্বোপরি ডলারের বিনিময় হারের ওপর। গত কয়েক মাস ধরে ডলারের বিনিময় হারে ওঠানামা এবং স্থানীয় পর্যায়ে ডলারের সরবরাহে চাপ আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে—যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে স্বর্ণের দামে।
বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জুয়েলারি খাতে মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তেজাবি সোনা হলো স্বর্ণের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রূপ, যা পরিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৯৯.৯ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধতায় উন্নীত করা হয়। গয়না তৈরির ক্ষেত্রে এই বিশুদ্ধ স্বর্ণই কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর মূল্য বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়; ফলে বাজারে খুচরা পর্যায়েও দাম সমন্বয় করতে হয়।
মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা জুয়েলারি শিল্পের বিনিয়োগ, উৎপাদন, বিক্রয় এবং কর্মসংস্থান কাঠামোতেও প্রভাব ফেলছে। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানান, স্বর্ণের দাম বাড়লে ক্রেতাদের ক্রয়ের গতি কমে যায়, বিক্রি সংকুচিত হয় এবং স্টক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি বাড়ে। তবে উৎসব, বিয়ে মৌসুম ও সামাজিক আয়োজনকেন্দ্রিক চাহিদা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও ক্রেতারা পরিমাণে কম ও ডিজাইনে হালকা গয়নার দিকে ঝুঁকছেন।
সোনার পাশাপাশি রুপার দামও বৃদ্ধি পেয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাজুসের সমন্বয় অনুযায়ী, ২২ ক্যারেট রুপার প্রতি ভরি ৬ হাজার ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২১ ক্যারেট রুপার দাম ৫ হাজার ৫৭৪ টাকা, ১৮ ক্যারেট রুপার দাম ৪ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির রুপার দাম ৩ হাজার ৭৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্বর্ণ ও রুপার দামের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা মূল্যবান ধাতুর বিনিয়োগ চাহিদাকেও আলোচনায় এনেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে দেখা হলেও উচ্চ দামের কারণে ছোট বিনিয়োগকারীরা বার বা কয়েন কেনার ক্ষেত্রেও এখন সতর্ক কৌশল নিচ্ছেন। একইসঙ্গে, অলংকার হিসেবে স্বর্ণ ক্রয়ের পাশাপাশি বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে স্বর্ণ কেনার প্রবণতাও বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটি পরোক্ষ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্থানীয় পর্যায়ে পিওর গোল্ডের সরবরাহ, ডলার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, বৈধ আমদানি কাঠামোর ব্যয় সহনশীল রাখা এবং পরিশোধন সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যবান ধাতুর বাজারে ভারসাম্য আনা গেলে ভবিষ্যতে মূল্যবৃদ্ধির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তবে বৈশ্বিক স্বর্ণবাজার ও মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলমান থাকলে দেশীয় বাজারে স্বর্ণের দামে আরও সমন্বয় আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।


