গফরগাঁওয়ে রেললাইন অপসারণে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত

গফরগাঁওয়ে রেললাইন অপসারণে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত

জেলা প্রতিনিধি

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে রেললাইন অপসারণের ঘটনায় ঢাকাগামী অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) ভোররাত ৫টা ১০ মিনিটে গফরগাঁও স্টেশনে প্রবেশের আগমুহূর্তে জন্মেজয় এলাকার তারাকান্দি থেকে ছেড়ে আসা এই ট্রেনের ইঞ্জিন ও দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।

গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, স্টেশনে ঢোকার আগে জন্মেজয় এলাকার জন্মেজয় থেকে গফরগাঁও রেলপথের অংশে দুর্বৃত্তরা আনুমানিক ২০ ফুট রেললাইন সরিয়ে ফেলায় ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। তবে ঘটনার সময় স্টেশন মাস্টার ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাথমিক প্রতিবেদনের বরাতে তিনি জানান, রেললাইন সরিয়ে ফেলার কারণে ট্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাইনচ্যুত হয়েছে।

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) ময়মনসিংহ অঞ্চলের পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। আনুমানিক ২০ ফুট রেললাইন উপড়ে বা অপসারণ করে ফেলার কারণেই ইঞ্জিন ও দুই বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। আরএনবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে রয়েছে এবং রেল চলাচল স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।”

একই বাহিনীর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আরেক পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, লাইনচ্যুত অংশটি গফরগাঁও স্টেশনের কাছাকাছি হলেও এটি স্টেশন এলাকায় প্রবেশের আগের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। তিনি বলেন, “রেললাইন উপড়ে ফেলা বা সরিয়ে ফেলা পরিকল্পিত নাশকতার ইঙ্গিত বহন করে। তবে তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।”

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ময়মনসিংহ পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, “দুর্বৃত্তরা রেললাইন সরিয়ে ফেলায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে—এটি স্পষ্ট। আমরা আলামত সংরক্ষণ করেছি। রেললাইন পুনঃস্থাপন ও উদ্ধার তৎপরতা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।”

ঘটনার প্রেক্ষাপটে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টিও তদন্তে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুরে ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পান আক্তারুজ্জামান বাচ্চু। মনোনয়ন ঘোষণার পর মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের সমর্থক ও কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু করেন।

স্থানীয় পর্যায়ের আন্দোলন ও অসন্তোষ রেললাইনে নাশকতার সঙ্গে যুক্ত কি না—এমন প্রশ্ন তদন্তের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় বা জেলা পর্যায়ের কোনো দায়িত্বশীল নেতার পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “রেললাইন উপড়ে ফেলা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। এটি জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর বিরুদ্ধে নাশকতা হিসেবে গণ্য হয়। কারা এর সঙ্গে জড়িত, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কোনো প্রভাব আছে কি না, কিংবা এটি স্থানীয় কোনো গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম কি না—সব দিকেই তদন্ত চলছে।”

রেলওয়ে পুলিশ ও আরএনবি সূত্র জানায়, লাইনচ্যুত ট্রেন উদ্ধারে রেলওয়ের উদ্ধারকারী দল ময়মনসিংহ থেকে রওনা দিয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন দ্রুত পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে ৬–৮ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরিস্থিতি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বিবেচনায় সময়ের তারতম্য হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

রেল যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনায় ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া বিরল নয়; তবে এর পেছনে মানবসৃষ্ট নাশকতার প্রমাণ মিললে তা রেল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাদের মতে, “রেলপথের নিরাপত্তা কেবল স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; স্টেশনের বাইরে রেললাইনের দীর্ঘ অংশ নিরাপত্তা নজরদারির বাইরে থেকে গেলে এমন ঝুঁকি বাড়ে। তাই প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, ড্রোন প্যাট্রল, সেন্সরভিত্তিক ট্র্যাক মনিটরিং, ও গোয়েন্দা তথ্যসমন্বয় আরও জোরদার করা প্রয়োজন।”

বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেল অবকাঠামোতে নাশকতার ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা বা নির্বাচনকেন্দ্রিক সময়গুলোতে রেলপথ ঝুঁকিতে পড়ার নজির রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এ ধরনের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর দ্রুত প্রতিক্রিয়া, সমন্বিত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে রেল নিরাপত্তা নিয়ে জনআস্থা ক্ষুণ্ন হতে পারে।”

এদিকে, ট্রেন লাইনচ্যুতের পর ঢাকামুখী রেল চলাচল সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। গফরগাঁও-তারাকান্দি-ঢাকা রুটে চলাচলকারী অন্যান্য ট্রেনের সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং বিকল্প লাইনে ট্রেন পরিচালনার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, আলামত সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। মামলার প্রস্তুতি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

এই ঘটনায় রেল অবকাঠামো সুরক্ষা, স্থানীয় রাজনৈতিক উত্তেজনা, এবং নাশকতার অভিযোগ—সব মিলিয়ে গফরগাঁওয়ে রেল নিরাপত্তা ইস্যুতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনার প্রকৃত কারণ ও জড়িতদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসেনি।

শীর্ষ সংবাদ সারাদেশ