জাতীয় ডেস্ক
বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত ৫৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৫১টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে মোট ২ হাজার ৫৮২টি মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ শাখার পরিচালক মো. রুহুল আমিন মল্লিক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৯টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। এছাড়া তিনটি রাজনৈতিক দল—প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), ফ্রিডম পার্টি এবং ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলনের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফলে বাস্তবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিতে পারছে ৫১টি নিবন্ধিত দল।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেয়ার সময়সীমা শেষ হয়েছে এবং জমাকৃত মনোনয়নপত্রের সংখ্যা ২,৫৮২। এটি একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় প্রার্থী অংশগ্রহণের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করছে, যা নির্বাচনকে বহুদলীয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো প্রদান করছে।
নির্বাচনী সময়সূচি ও প্রক্রিয়া
সংশোধিত তফসিল অনুযায়ী, প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাই শুরু হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর থেকে, যা চলবে ২০২৬ সালের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তারা জমাকৃত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করে বৈধতা নির্ধারণ করবেন। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা যাবে ৫ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। আপিল নিষ্পত্তি হবে ১০ থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২০ জানুয়ারি। ২১ জানুয়ারি রিটার্নিং কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে প্রতীক বরাদ্দ দেবেন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হবে ২২ জানুয়ারি। প্রচারণা চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। আর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৬।
এই সময়সূচি অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন প্রশাসনিক, লজিস্টিক ও আইনগত প্রস্তুতি এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে প্রার্থী ও দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। মনোনয়নপত্র বাছাই, আপিল নিষ্পত্তি, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও প্রতীক বরাদ্দ—এই চারটি ধাপ নির্বাচনী প্রতিযোগিতার আইনি কাঠামোকে দৃঢ় ভিত্তি দেয়।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও শোকাবহ পরিবেশ
এদিকে, বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক পরিবেশে শোকের আবহ বিরাজ করছে। ইসি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বুধবার (১ জানুয়ারি) রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপি দেশব্যাপী চলমান গণভোট-সংক্রান্ত সব প্রচার কার্যক্রম বুধবার পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে।
এই স্থগিতাদেশ নির্বাচনী প্রচারণার অংশ নয়; এটি গণভোট প্রচারণা কার্যক্রম, যা দলীয় সিদ্ধান্তের আওতায় সাময়িক বিরত রাখা হয়েছে। তবে ইসি জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মূল তফসিল ও আইনি কার্যক্রম যথারীতি চলমান থাকবে। খালেদা জিয়ার প্রয়াণ রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেললেও, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সময়সূচি মেনে নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।
প্রার্থী অংশগ্রহণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ
৩০০ আসনে ২,৫৮২ মনোনয়নপত্র জমা পড়ার অর্থ হলো, গড়ে প্রতি আসনে প্রায় ৮–৯ জন করে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। যদিও সব মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে এই সংখ্যা কমে আসবে, তবু প্রাথমিক দাখিলকৃত মনোনয়নের পরিমাণ নির্বাচনী আগ্রহ ও বহুমাত্রিক দলীয় অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দেয়।
ইসি জানিয়েছে, বাতিলকৃত দলগুলোর বাইরে অন্যান্য ছোট, মাঝারি ও বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা অনুযায়ী প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী দল, বামপন্থী দল, আঞ্চলিক দলসহ বহুবিধ মতাদর্শের দল অংশ নেয়ায় নির্বাচন একটি বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপ পাচ্ছে।
নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ও গণতান্ত্রিক তাৎপর্য
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বহুদলীয় অংশগ্রহণের সংখ্যা বেশি হওয়া নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো দিলেও, প্রকৃত প্রতিযোগিতা নির্ভর করবে বড় দলগুলোর প্রার্থী তালিকা, ভোটের মাঠে সাংগঠনিক শক্তি, প্রচারণার কৌশল, জনসমর্থন এবং নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালনের ওপর।
ইসি জানিয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রার্থী যোগ্যতার আইনি শর্ত পূরণ না হওয়া, বা কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট মনোনয়ন বাতিল করা হবে। আপিল নিষ্পত্তি ধাপে এই বাতিলাদেশ পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকবে, ফলে আইনি প্রতিকার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রশাসনিক প্রস্তুতি
ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, ব্যালট বা ইভিএম পরিকল্পনা (যা প্রযোজ্য), প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুতকরণ এবং ভোট পর্যবেক্ষণের কাঠামো নির্ধারণে কাজ চলছে।
ইসি সচিবালয় জানিয়েছে, মনোনয়ন বাছাই থেকে প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত সময়কে তারা ‘নির্বাচনের প্রাক-প্রতিযোগিতা ধাপ’ হিসেবে বিবেচনা করছে, আর ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ‘আনুষ্ঠানিক প্রচারণা ধাপ’ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যেই প্রার্থীরা জনসংযোগ, প্রচার ও নির্বাচনী বার্তা পৌঁছানোর সুযোগ পাবেন।
উপসংহার
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৫১ দলের অংশগ্রহণ ও ২,৫৮২ মনোনয়নপত্র দাখিলের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রতিযোগিতার প্রাথমিক চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। মনোনয়ন বাছাই ও আপিল নিষ্পত্তির পর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ, প্রতীক বরাদ্দ ও প্রচারণা শুরু হলে নির্বাচনের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপ আরও পরিষ্কার হবে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।


