খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ব্রিটিশ হাইকমিশনে পতাকা অর্ধনমিত

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ব্রিটিশ হাইকমিশনে পতাকা অর্ধনমিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খালেদা জিয়ার সম্মানে বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনে যুক্তরাজ্যের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।

ব্রিটিশ হাইকমিশন ঢাকায় পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক বার্তায় জানায়, খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক পালনের অংশ হিসেবে বুধবার হাইকমিশনের যুক্তরাজ্যের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। বার্তায় আরও বলা হয়, “এই দুঃসময়ে আমাদের চিন্তা ও সমবেদনা তার পরিবার এবং বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে রয়েছে।” আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে এটি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা খালেদা জিয়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুই দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে সক্রিয় থাকা এই নেত্রী ১৯৮৩ সালে সামরিক শাসনের বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন এবং ১৯৮৪ সালে বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এর পর থেকে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংসদীয় রাজনীতি, সরকার পরিচালনা এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে তিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

খালেদা জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৯১ সালে তার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। তার আমলে দেশের বেসরকারি খাতের প্রসার, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে অগ্রযাত্রা এবং প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার বৃদ্ধির মতো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর বুধবার থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক কর্মসূচি আগামী শুক্রবার (২ জানুয়ারি) পর্যন্ত চলবে। শোক কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, শোকের তিন দিন দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। এ সময় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সব ধরনের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শোক সভা ও দোয়া মাহফিল আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে সাময়িক বিরতি এলেও জরুরি সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণপরিবহন, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহসহ অত্যাবশ্যক পরিষেবাগুলো স্বাভাবিকভাবে চালু রয়েছে। শোক কর্মসূচি পালনে মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো প্রয়োজনীয় সমন্বয় করছে।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক মহলেও শোকবার্তা পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা পৃথক বিবৃতিতে তার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার ভূমিকা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে বিভিন্ন দেশ তার মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন করছে।

ব্রিটিশ হাইকমিশনে পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা এবং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়ার প্রভাবের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতিফলন। কূটনীতিতে পতাকা অর্ধনমিত রাখা সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান বা সমপর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিরল প্রতীকী উদ্যোগ, যা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার জানাজা, দাফন ও আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে সমন্বয় করে জানানো হবে। তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের আবহ বিরাজ করছে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তার রাজনৈতিক জীবন ও অবদান স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়া এক অনন্য অধ্যায়ের নাম। তার প্রয়াণে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল, তবে তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় গৃহীত নীতিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘসময় আলোচনায় ও বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ