ইসমাইল আলী ও হামিদুর রহমান: ডিজিটাল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। সে লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ঘরে ঘরে বা হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এর কারণ, দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি রয়ে গেছে ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে।
তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে বৈশ্বিক চিত্র বিবেচনায় বর্তমানে ইন্টারনেট সংযোগহীন জনগোষ্ঠীর শীর্ষ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টার সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইন্টারনেট ইউজেস ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট সংযোগহীন জনগোষ্ঠী ভারতের। দেশটিতে ৬৮ কোটি ৫৬ লাখ বা প্রায় ৫০ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনে ৫৮ কোটি ২১ লাখ বা ৪১ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তান। দেশটির ১৪ কোটি ২৩ লাখ বা ৬৫ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে।
ইন্টারনেট সংযোগহীন জনগোষ্ঠীর শীর্ষ তালিকায় এরপর রয়েছে নাইজেরিয়া। দেশটির ১১ কোটি ৮১ লাখ বা ৫৮ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে। তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের ৯ কোটি ৭৪ লাখ বা ৫৯ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে। এরপরের অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ার ৯ কোটি ৬৭ লাখ বা ৩৬ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে। আর সপ্তম অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ার ৯ কোটি ২৪ লাখ বা ৮১ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে।
ইন্টারনেট সংযোগহীন জনগোষ্ঠীর শীর্ষ তালিকায় এরপর রয়েছে যথাক্রমে কঙ্গো, ব্রাজিল ও মিসর। দেশ তিনটিতে ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছে যথাক্রমে সাত কোটি ১৮ লাখ (৮১%), ছয় কোটি ১৪ লাখ (২৯%) ও চার কোটি ৬৬ লাখ (৪৬%) জনগণ।
ইন্টারনেট সংযোগে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সমৃদ্ধ। সেই টুজির আমল থেকে এখন দেশে ফোরজি চালু হয়েছে। ফাইভজি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার ছিল ৮ জিবিপিএস। বর্তমানে দেশে ২১০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এখন ঘরে বসে অফিসের কাজ করছে। শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থ-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন অনলাইনমুখী। ইন্টারনেট ব্যবহারে এখন সারা দেশে চাহিদা তৈরি হয়েছে। এর আগে ব্রডব্যান্ড সংযোগ এতটা ছিল না। এখন তার প্রয়োজনটা তৈরি হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে এসেছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ দ্রুতই ইন্টারনেট ব্যবহারে বা প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নত দেশগুলোকেও পেছনে ফেলবে।
এদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর দিক থেকে বর্তমানে চীন শীর্ষে রয়েছে বলে স্ট্যাটিস্টার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৮৫ কোটি ৪০ লাখ। এরপর রয়েছে ভারত। দেশটির ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৬ কোটি। তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩১ কোটি ৩৩ লাখ।
এছাড়া চতুর্থ অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৭ কোটি ১২ লাখ, পঞ্চম স্থানে থাকা ব্রাজিলের ১৪ কোটি ৯১ লাখ, ষষ্ঠ স্থানে থাকা নাইজেরিয়ার ১২ কোটি ৬১ লাখ, সপ্তম স্থানে থাকা জাপানের ১১ কোটি ৮৬ লাখ ও অষ্টম স্থানে থাকা রাশিয়ার ১১ কোটি ৬৪ লাখ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশে। এদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৪২ লাখ ও ১০ম স্থানে থাকা মেক্সিকোয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা আট কোটি ৮০ লাখ।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের বৈশ্বিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে স্ট্যাটিস্টা। তবে করোনায় দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেশ কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এতে গত জুন শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহাকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৯ কোটি ৪৯ লাখ বা প্রায় ৯২ শতাংশ। বাকিটা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট।
যদিও দেশে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর মোট শুল্ক ৩৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ দিতে হয়। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১ শতাংশ সারচার্জ। এছাড়া দেশের মোবাইল ফোন খাতে রয়েছে ওলিগোপলি বাজার (সীমিত সংখ্যক অপারেটর)। এতে অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। ফলে দেশে মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের মূল্য কমছে না।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১জিবি ইন্টারনেটের গড় মূল্য ভারতের প্রায় চারগুণ। কেব্ল.কো.ইউকের ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড মোবাইল ডেটা প্রাইসিং: দ্য কস্ট অব ১জিবি অব মোবাইল ডেটা ইন ২৩০ কান্ট্রিজ’ শীর্ষক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের ২৩০টি দেশের ৬ হাজার ৩১৩টি ১জিবি মোবাইল ডেটা প্ল্যান যাচাই-বাছাই পূর্বক এ বিশ্লেষণটি প্রণয়ন করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের প্রায় একই সময়ের ডেটা প্ল্যানের মূল্য বিবেচনা করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বে ১জিবি মোবাইল ডেটার সর্বনিন্ম মূল্য ভারতে। দেশটিতে ১জিবি ডেটা কিনতে গ্রাহকদের গড়ে ব্যয় হয় ২৬ সেন্ট। আর বাংলাদেশে ১জিবি মোবাইল ডেটার গড় মূল্য ৯৯ সেন্ট। আর ১জিবি ডেটার মূল্য বিবেচনায় বিশ্বে বর্তমানে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
তথ্যমতে, ভারতে ৫৭টি ১জিবি মোবাইল ডেটা প্ল্যান রয়েছে। এগুলোর মূল্য দুই সেন্ট থেকে ১ ডলার ৪০ সেন্টের মধ্যে, স্থানীয় মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ১ দশমিক ৭৫ রুপি থেকে ৯৯ দশমিক ৯০ রুপি। আর দেশটির ১জিবি মোবাইল ডেটার গড় মূল্য ২৬ সেন্ট তথা ১৮ দশমিক ৫০ রুপি। এদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে ১জিবি মোবাইল ডেটা প্ল্যান রয়েছে ৫৩টি। এগুলোর মূল্য ১৮ সেন্ট থেকে ৩ ডলার ৮১ সেন্টের মধ্যে, দেশীয় মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৯৭ পয়সা থেকে ৩২০ টাকা। আর ১জিবি মোবাইল ডেটার গড় মূল্য ৯৯ সেন্ট তথা ৮২ টাকা ৮৫ পয়সা।
যদিও শুধু ভারতই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায়ও ১জিবি মোবাইল ডেটার মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। মিয়ানমারে ১জিবি মোবাইল ডেটার গড় মূল্য ৮৭ সেন্ট ও শ্রীলঙ্কায় ৭৮ সেন্ট।
ইন্টারনেটের উচ্চ দাম প্রসঙ্গে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখা দরকার ভারত কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে ২৩ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে। সেখান থেকে বাংলাদেশকে আজকের জায়গায় নিয়ে আসাটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবে গত এক যুগে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আর ভারতে গ্রাহক সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এছাড়া তাদের রয়েছে নিজস্ব সাবমেরিন কেব্ল। অথচ বাংলাদেশের সাবমেরিন কেব্ল সংযোগ নিতেই ১৪ বছর পিছিয়ে থাকতে হয়েছে। তাই এত কম সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা ঠিক হবে না। সেই অনুপাতে বাংলাদেশের মানুষকে আমরা ভালো রেটে ইন্টারনেট সংযোগ দিতে পারছি।’