সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের অনাগ্রহে গ্রামের সব খাতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরে এদের মাধ্যমে গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ও অর্থায়নকারী সংস্থা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি, নারী উদ্যোক্তা, অপ্রাতিষ্ঠানিক ও কৃষি খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হবে। এসব খাতে ঋণের জোগান বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হলেও তারা সেটি করছে না। টাকা আদায় না হওয়ার আশঙ্কা ও গ্রাহক বাছাইয়ে জটিলতার কারণে ব্যাংকগুলো গ্রামে ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।
এদিকে গ্রামে যেসব অর্থের জোগান দেয়া হয় তার ৮০ শতাংশই যাচ্ছে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে। যে কারণে তারা দ্রুত ও সহজে ঋণ ছাড় করতে পারে। এ কারণে এদের মাধ্যমে গ্রামে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করার কথা ভাবা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব মোকাবেলা করতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতে ঋণ দিতে ৫ হাজার কোটি টাকা, কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা, ক্ষুদ্রঋণের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা, শস্য বহুমুখীকরণের জন্য ২০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা দেয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে। এর বাইরে সরকার থেকে চারটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো গ্রামে এসব টাকা বিতরণ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকগুলোর গ্রামের শাখা পর্যায় এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারগুলা পৌঁছেনি। যে কারণে গ্রামের শাখাগুলোতে ঋণগ্রহীতারা গেলে ব্যাংক কর্মকতারা কিছুই বলতে পারছে না। অন্যদিকে প্রধান কার্যালয় থেকে বলা হচ্ছে, সার্কুলার পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রাহকরা ঋণ নিতে আসছেন না বলে বিতরণ হচ্ছে না। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গ্রামে শাখা খুবই কম বলে তারা সরাসরি কৃষক পর্যায়ে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না।
এদিকে গত অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। বিতরণ করা হয়েছে ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল সোয়া ১২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে কমেছে সোয়া ২ শতাংশ। গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল সাড়ে ৪ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে কমেছে সাড়ে ৮ শতাংশ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০৩ কোটি টাকা শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের আওতায় হোলসেল পদ্ধতিতে বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের অর্থায়নে ব্র্যাক এসব ঋণ বিতরণ করছে।
মার্চ থেকে মাঠপর্যায়ের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় স্থগিত করেছে। এর কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকট মেটাতে সরকারের কাছে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে। এত টাকা জোগান দেয়ার সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের গ্রামীণ অংশ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিতরণের প্রস্তাব দিয়েছে।
সূত্র জানায়, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তহবিলের তেমন সংকট না থাকলেও ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ সংকট প্রকট হয়েছে। সংকটের কারণে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সার্কুলার জারি করে কর্মীদের বেতন- ভাতা পরিশোধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করেছে।
এমআরএর নিবন্ধন নিয়ে মাঠপর্যায়ে ৮০০ প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে। প্রতি মাসে তারা গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। এর ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ আদায় হয়। এ হিসাবে মাসে ১১ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায় হয়। কিস্তি আদায় বন্ধ থাকায় এসব অর্থ আদায় হচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় গ্রাহকরা এখন কিস্তি দিতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির পরিচালক ও করোনায় ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন বলেন, মাঠপর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। এদের মাধ্যমে সহজে ও দ্রুত গ্রামের ছোট উদ্যোক্তা ও কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছানো সম্ভব। প্রণোদনা প্যাকেজ এদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলে একদিকে যেমন আর্থিক সংকট দূর হবে। অন্যদিকে দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে।
এদিকে ২০২টি প্রতিষ্ঠানকে তহবিলের জোগান দেয় পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। তারা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে সরকারের কাছে চেয়েছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত সরকার দিয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের কাছে ৮৫০ কোটি টাকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) কাছে চেয়েছে ১৬০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে পিকেএসএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল কাদের বলেন, করোনার প্রভাব মোকাবেলায় এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে টাকা পৌঁছাতে হবে। এ জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়ে তাদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের সুপারিশ করেছি।
সূত্র জানায়, পিকেএসএফ এখন পর্যন্ত তাদের সদস্য সংস্থাগুলোকে ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। সংস্থাগুলোর নিজস্ব তহবিলসহ মাঠে রয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। প্রায় দেড় কোটি পরিবারকে ১০ হাজার শাখার মাধ্যমে তারা নানাভাবে সহায়তা করে আসছে।