ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছে বিএনপি

টানা এক যুগের বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমানে চরম দুঃসময় পার করছে। রাজনীতির মারপঁ্যাচে বারবার ধরাশায়ী দলটি সাংগঠনিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে নানাভাবে চেষ্টা করলেও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যকর পথের সন্ধানে থাকা বিএনপি আজ ৪৩ বছরে পা দিচ্ছে। করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে দলটি।

দলটির তথ্য মতে, সারাদেশে ৮১টি সাংগঠনিক কমিটি মধ্যে মাত্র ৩৪টি পূর্ণাঙ্গ কমিটি, ২৩টি আহ্বায়ক কমিটি এবং ১৬টি আংশিক কমিটি করেছে। করোনায় দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। শিগগিরই বাকি জেলাতে নতুন কমিটি দেওয়া হবে।

বহুবিধ প্রতিকূলতা থাকলেও দ্রম্নত দল ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে, বিএনপি এখন অনেক গতিশীল হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। জেলা কমিটিগুলো নতুনভাবে হচ্ছে। দলের পুনর্গঠন কার্যক্রম কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আটকে আছে। অচিরেই তা শুরু হবে। বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে উঠবে।

আন্দোলন-সংগ্রামকে সামনে রেখে দলকে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন, জেলা, থানা, পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এসেছে নতুন কমিটি। দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি শীর্ষ নেত্রীকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করে ঘুরে দাঁড়াতে চান তারা। এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা নানামুখী রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও তা খুব সহজ মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সারাদেশে বিএনপির এখনো অনেক জনসমর্থন রয়েছে; কিন্তু সাংগঠনিক কাঠামো ততটা শক্তিশালী নয়। দলটি এখনো নেতা-কর্মীবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া একের পর এক রাজনৈতিক ‘ভুল’ সিদ্ধান্তে পিছিয়ে পড়ে দলটি। নানা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর না হলে ঘুরে দাঁড়ানো বিএনপির জন্য কঠিন হবে।

গত সাড়ে তিন যুগে উত্থান-পতনের মধ্যে সময় পার করা বিএনপি বর্তমানে ঘুরে দাঁড়াতে লড়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সমস্যার আবর্তে পড়ছে। সাজা হওয়ার কারণে জিয়া পরিবারের শীর্ষ দুই কর্ণধার খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেননি। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বিভাজন ও সন্দেহ-অবিশ্বাস আরও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠার পর দল একাধিকবার ভাঙনের মুখে পড়লেও শক্ত নেতৃত্বের কারণে বিগত সময়ে তেমন বড় কোনো সমস্যা হয়নি; কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। শীর্ষ দুই নেতা আইনি জটিলতায় স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে না পারায় চরম সংকটের মুখে রয়েছে বিএনপি।

দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করতে সাংগঠনিক তেমন কোনো তৎপরতা নেই বিএনপির। দলও অগোছাল। এক যুগ ধরে ক্ষমতায় বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও নানা ধরনের হতাশা কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে একাদশ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর আন্দোলনমুখী না হয়ে আবার দল পুনর্গঠনের কাজে নেমেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে নেওয়া হবে নতুন কর্মসূচি। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে শক্তিশালী করে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

দলীয় সূত্রমতে, ঘুরে দাঁড়ানোর সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে মামলা-হামলা। দলের তথ্য অনুযায়ী, এক লাখের ওপর রাজনৈতিক মামলা রয়েছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে, সেখানে আসামি করা হয়েছে ৩৫ লাখের ওপরে ব্যক্তিকে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই বিরোধী দলের নেতাকর্মী। গত ১০ বছরের মধ্যে জেল কাস্টডিতে মারা গেছেন ৭৯৫ জন, গুম হয়েছেন ৬০১ জন।

রমনার বটমূলে গোড়াপত্তন

ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত ‘রমনা বটমূলে’ই গোড়াপত্তন হয়েছিল বিএনপির। বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৭৭ সালের জুনে প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯ দফা কমর্সূচি নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগো দল) গঠন করেন। ওই দলের আহ্বায়ক হয়েছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এরপর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করে জিয়া ওই বছরে প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। জাগো দল, ন্যাপ (মশিউর রহমান যাদু মিয়া), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম-আকরর হোসেন), লেবার পার্টি (মতিন) ও মুসলিম লীগ (শাহ আজিজুর রহমান) নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়, যাতে বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, শাহ আজিজুর রহমান, অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এসএ বারী এটি, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম, জামাল উদ্দিন আহমেদ, মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদ-উল হক, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, এম সাইফুর রহমান, মাওলানা আবদুল মতিন, কর্নেল (অব.) আসম মোস্তাফিজুর রহমান, লে. কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, আতাউদ্দিন খান প্রমুখ নেতা ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। দলের ১১ সদস্যের স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। মহাসচিব হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় অধ্যাপক বি. চৌধুরীকে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই ছিল জিয়াউর রহমানের মূলমন্ত্র। ফলে প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই অভূতপূব সাফল্য এসে ধরা দেয়। জিয়াউর রহমান স্বল্প সময়ের অক্লান্ত কর্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েন পুরো দেশে। জনগণ তাকে গ্রহণ করে তৎকালীন সময়ের বিকল্প এক রাজনীতিবিদ হিসেবে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে ইসলামী মূল্যবোধের মিশ্রণ তার দলকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। তার ঘোষিত ১৯ দফা দল ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এক ‘রাজনৈতিক দর্শন’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যের হাতে জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের কিছু পর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান ঘটে খালেদা জিয়ার। সে সময় থেকে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনিই।

বাংলাদেশে একাধিক বার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ১৯৯০ সালের গণতন্ত্রায়নের পর ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশে মোট চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তিনটিতেই জয়লাভ করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৪২টি আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি নির্বাচনেও বিএনপি জয়লাভ করে। তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আন্দোলনমুখী হওয়ায় কয়েকদিনের মাথায় বিএনপি সরকার একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আবার নির্বাচন করার জন্য ক্ষমতা তুলে দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ চারটি দল প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে। তবে এক-এগারোর সরকারের ২ বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনের নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেননি তারা। এরপর দাবি আদায় না হলেও ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে নির্বাচনসহ জাতীয় রাজনীতিতে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দলীয় প্রধানের সাজা বিএনপিকে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছে।

বাণী : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাণীতে বিএনপি মহাসচিব প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী এবং জনগণকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানোর পাশাপশি দেশবাসীকে বিএনপির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি : কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সকাল ৬টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, বেলা ১১টায় প্রতিষ্ঠাতা শহিদ জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের মাজারে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ফাতিহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকাল সাড়ে ১১টায় মহানগর দক্ষিণ ও দুপুর ১২টায় উত্তর বিএনপির শহিদ জিয়ার মাজারে ফাতিহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ। বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হবে বিকেল সাড়ে ৩টায়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ