গুটিয়ে আসছে চাকরির বাজার

কেস স্টাডি-১ : একটি মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ অফিসের মধ্যমসারির কর্মকর্তা জায়েদ ফারুক। করপোরেট বাজারে তুলনামূলক উচ্চ বেতনের চাকুরে। হঠাৎ গত জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে তাকে ছাঁটাই করে কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানে নতুন যোগ দিয়ে করোনার থাবায় এখন বেকার তিনি। খুব শিগগির চাকরির আশাও দেখছেন না। অথচ গত দেড় দশকে একটি ভারতীয় কোম্পানি, একটি মাল্টিন্যাশনাল সিগারেট কোম্পানি ও একটি বিদেশি ব্যাংকে একের পর এক চাকরি করা জায়েদকে এক দিনের জন্যও বেকার থাকতে হয়নি। তাকেই এখন ঢাকা ছেড়ে নরসিংদীর বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

কেস সটাডি-২ : জাফর ইকবাল মিঠু। দুবাইপ্রবাসী বাংলাদেশি। ১০ বছর ধরে কাজ করছেন দুবাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠানে। গতকাল হঠাৎই ফোন করে জানান, তার কোম্পানি থেকে ১৬৯ জন শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। কাল (আজ) থেকেই তারা আর কাজে যেতে পারবেন না। বকেয়া পরিশোধ করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি নিজেও উদ্বিগ্ন। নতুন কোনো ছাঁটাই তালিকা হলে নিজেও হয়ে পড়তে পারেন কর্মহীন; যার ফল হবে দেশে ফিরে আসা। এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। ফলে দেশে ফিরে আসছেন বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক। এতে প্রচ- চাপ তৈরি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে কাজের বাজারে। এমনিতেই কাজের সুযোগ খুব সীমিত হয়ে এসেছে করোনার কারণে।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চাকরির বাজার গুটিয়ে আসছে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা, ব্যাংক-বীমা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ফলে নতুন চাকরির সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে চাকরিচ্যুতি করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এতে বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সব ক্ষেত্রে। শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত দুই শ্রেণির চাকরিজীবীই বাধ্য হচ্ছে ঢাকা ছাড়তে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে যে পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বের হচ্ছেন, সে পরিমাণ কর্মক্ষেত্র নেই। ফলে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে এসএসসি পাস বা এর নিচে থাকা জনগোষ্ঠী শ্রমিক হিসেবে বা কারিগরি বিভিন্ন খাতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার আগে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে গড়ে ১২ জন বেকার ছিলেন। এখন তা বেড়ে প্রায় ২৫ জন হয়েছে। এর সঙ্গে আছে পুরনো ২৭ লাখ বেকার। আগস্টে প্রকাশিত ‘ট্যাকলিং দ্য কভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার স্বল্পমেয়াদি প্রভাবে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হারাতে পারে ১১ লাখ ১৭ হাজার যুব শ্রমশক্তি। যদি ছয় মাসের প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে বেকার হতে পারে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার যুব শ্রমশক্তি। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে শুধু তৈরি পোশাকশিল্পে। এ ছাড়া কৃষি খাত, খুচরা বিক্রেতা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহনসহ সেবা খাতে নিয়োজিত তরুণরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট বেকারের প্রায় ৭৬ শতাংশ হতে পারে এসব খাতে। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপাল, পাকিস্তানেরও বেকার দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের তরুণ বেকারত্বের হার ২৩ দশমিক ৩ ও শ্রীলঙ্কার বেকারত্বের হার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এশিয়া অঞ্চলে তরুণরা এমনিতেই শ্রমবাজারে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। করোনার কারণে ‘লকডাউন প্রজন্ম’ তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব দীর্ঘদিন থাকবে। করোনার তাৎক্ষণিক প্রভাবে লকডাউন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতি হওয়ায় কাজ হারিয়েছে বহু তরুণ। সমাজে এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেকার সমস্যা আমাদের জন্য নতুন কোনো সমস্যা নয়। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। সরকারের উচিত স্বল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণিবিন্যাস করে পৃথকভাবে পরিকল্পনা করা। আর কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যায় শিক্ষিতদের কাজে লাগানো। ছোট ছোট ক্লাস্টারে ঋণ দিতে হবে। এই ধরেন কারও একটা বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে সেখানে ১০ হাজার টাকা আছে। তাকে যদি এর বিপরীতে আরও কিছু দেওয়া যায় ঋণ হিসেবে। তাহলে সে কিছু একটা করতে পারবে। তরুণদের উদ্ভাবনী কাজে লাগাতে হবে। যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন তাদের আয়ের অর্থ বিদেশ থেকে আনার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, বেসরকারি খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। কিন্তু করোনার কারণে এ খাতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ খাতকে সহায়তা দিয়ে অর্থনীতিটা সচল রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘১০০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচিটাকে আবার চালু করা যায়। করোনাকালীন কর্মসৃজন কর্মসূচি সরকার কেন নিচ্ছে না আমি বুঝতে পারছি না। এনজিও ফাউন্ডেশনের অধীনে এতগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো এখন কী করছে? কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন? তাও দেখা দরকার। আর বিদেশ থেকে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেখানে আরও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।’

সূত্র জানান, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য ৩০ জুন ১ হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ, যা কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আড়াই শ কোটি টাকা করে বিতরণ করবে। এ অর্থ বিদেশ থেকে ফিরে আসা যুবক ও অন্য বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। এর সুদের হার হবে খুব অল্প। এর মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব সমস্যা অনেকটাই কাটবে বলে মনে করে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ফিরে আসা প্রবাসীদের যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে আগ্রহী তাদের মধ্যে বিতরণের জন্য ইতোমধ্যে তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক ও পিকেএসএফের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শূন্য সুদের (সুদমুক্ত) হারে তাদের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সরকারের এ উদ্যোগ বেকারত্ব ঘোচাতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কভিড-১৯-এর কারণে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। এটা শুধু আমাদের এখানেই নয়, সারা বিশ্বের একই অবস্থা। এখানে আপাতত আপৎকালীন সহায়ক হিসেবে কিছু কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বিদেশ থেকে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ফিরে আসছেন তাদের জন্য যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেখানে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মানুষকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে।’

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ