বিদেশের ১৯টি মিশনে পোস্টিং নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চার বছরেও সুরাহা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ থেকে সমহারে নিয়োগ/পদায়নের সিদ্ধান্ত থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না।
উল্টো মিশনের ৭৩টি পদে সুরক্ষা বিভাগ থেকে এককভাবে পোস্টিং দেয়ায় নীতি গ্রহণ করায় ক্ষোভ-অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দূতাবাসগুলোয় এই প্রাইজ পোস্টিংয়ের ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে এখন জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একরকম মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
সবশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগকে বাদ দিয়ে শুধু সুরক্ষা বিভাগ থেকে ৪ জনকে বিদেশ মিশনে পোস্টিং দেয়ায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তবে এ দাবি অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। আছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।
জননিরাপত্তা বিভাগের সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সবচেয়ে বড়কথা হল- নথিতে মন্ত্রীর দেয়া সিদ্ধান্ত মানা হচ্ছে না। এর চেয়ে বড় ব্যত্যয় আর কী হতে পারে। এ ছাড়া দ্বন্দ্ব নিরসনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে চিঠি দেয়া হলেও কার্যত কিছুই হয়নি। মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে মহলবিশেষের বাধার কারণে তারা দেখা পর্যন্ত করতে পারেন না। তবে তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ জন্য বাধা উপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। জননিরাপত্তা বিভাগের একটি প্রতিনিধিদল আজ-কালের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অফিশিয়াল প্রস্তুতি নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘জননিরাপত্তা বিভাগের যে পরিপত্রের ভিত্তিতে বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে, সেটি মন্ত্রী মহোদয় বাতিল করার জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে ওই পরিপত্রের কোনো কার্যকারিতা থাকছে না। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, সুরক্ষা সেবা বিভাগ তো একটি স্বতন্ত্র বিভাগ। আমরা যেমন অন্য মন্ত্রণালয়ের কোনো সুবিধা পাওয়ার জন্য কথা বলতে পারব না, তেমনি বিদেশ মিশনে পোস্টিং দেয়ার বিষয়টিও এ বিভাগের নিজস্ব ব্যাপার।’
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন থেকে যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশ মিশনের নির্ধারিত ডেস্কে ২০১৪ সাল থেকে পোস্টিং পেয়ে আসছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমানে ১৯টি মিশনে তিন ক্যাটাগরিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ৭৩টি পদ রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ১৯টি। যেখানে ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় সচিব হিসেবে প্রথম শ্রেণির পদে পদায়ন করা হয়।
এ ছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির ১০টি এবং তৃতীয় শ্রেণির রয়েছে ৪৪টি পদ। স্বামী-স্ত্রী ও ২ সন্তানসহ ৪ বছর মেয়াদি এই প্রাইজ পোস্টিং পেতে অনেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। মিশন সংশ্লিষ্ট দেশগুলো হল : সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতারের দোহা, কুয়েত, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, ইতালি, জর্ডান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও বার্মিংহাম, কানাডার অটোয়া, হংকং এবং দক্ষিণ আফ্রিকার গিটুরিয়া।
সূত্র জানায়, আইন ও বিধিগত সবদিক পর্যালোচনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত নথির একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেন ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। যার মূল বিষয় ছিল- বিদেশ মিশনে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগ থেকে সমহারে নিয়োগ দিতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষরে ওই বছর ১ মার্চ একটি পরিপত্র জারি করা হয়।
সেখানে বলা হয়: বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা বিভাগ থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমহারে নিয়োগ/পদায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি করা হল। এ জন্য উভয় বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোয় সমহারে পদায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে দুই বিভাগের সচিবকে অন্তর্ভুক্ত নির্বাচন কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কমিটি এ সংক্রান্ত ২০১৪ সালের নীতিমালার ২.১, ৫.১, ৬.৮, ৭.১ এবং ১০.১ অনুচ্ছেদসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। কিন্তু মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত এবং এই পরিপত্র জারির ৩০ মাস পার হলেও সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এদিকে বিষয়টির বিধিগত ও সম্মানজনক সমাধান প্রত্যাশা করে এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন জননিরাপত্তা বিভাগের সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রতিকার চেয়ে লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেও পত্র দিয়ে আলোচনা করে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে দুই সচিবকে চিঠি দেয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠির প্রস্তাব যুক্ত করে ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নথি উপস্থাপন করা হলে তা আটকে দেয়া হয়। উপরন্তু সবকিছু পেন্ডিং রেখে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গত ২২ জুলাই বৈদেশিক মিশনের স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। যেখানে জননিরাপত্তা বিভাগের কাউকে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি।
এ ছাড়া এর ধারাবাহিকতায় সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে ১ জনকে মালয়েশিয়া, ১ জনকে লন্ডনে এবং গত ১৪ সেপ্টেম্বর আরও ৪ জনকে জর্ডান ও বাহরাইনে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। বিষয়টি জানার পর জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরও বেশি ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন। বিশেষ করে অবিভক্ত মন্ত্রণালয় থাকতে যাদেরকে ৪ বছর আগে পোস্টিং দেয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের মেয়াদ আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
ফলে আরও ৬৭ জনকে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু নীতিমালা সংশোধন করা না হলে জননিরাপত্তা থেকে ভবিষ্যতে কারও বৈদেশিক মিশনে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ চিরতরে রহিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। যদিও সংক্ষুব্ধদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। এ ছাড়া এর আগে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করা হয়। দুটি বিষয় এখনও বিচারাধীন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সুরক্ষা বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানিয়েছেন, প্রথম কথা হল- বিভাগ এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই সুরক্ষা সেবা বিভাগের বিষয় নিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব কোনো চিঠি/পরিপত্র জারি করতে পারেন না। তাই ওই চিঠির কোনো ভিত্তি নেই। দ্বিতীয়ত, পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন।
তাই সঙ্গত কারণে বিদেশ মিশনে পদায়ন তাদের বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ছাড়া এ বিষয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের প্রাথমিক আদেশ তাদের পক্ষে রয়েছে। তৃতীয়ত, মন্ত্রণালয় বিভক্ত হওয়ার সময় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত গেজেটের ‘বি-২(১) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: পাসপোর্ট ও ভিসা উইং সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের অধীন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশনের অফিসসমূহের কনসুলার সার্ভিস শাখায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও ৬টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ সেবা দিয়ে থাকে। বাকি মন্ত্রণালয় হল : পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, ইআরডি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।