আমানতকারীদের হাজার কোটি টাকা ফেরতে অক্ষম

আমানতকারীদের এক হাজার কোটি টাকা ফেরত দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) লিমিটেড। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিতভাবে অবহিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর বিআইএফসি সম্পর্কে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়, এ বিষয়টি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সূত্র জানায়, বিআইএফসির মোট আমানতের পরিমাণ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮০৮ কোটি টাকা। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি আর কোনো আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি। মুনাফাসহ আমানতের পরিমাণ বেড়ে এখন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিআইএফসিতে বারবার ধরনা দিয়েও আমানতকারীরা তাদের অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন। তাতে কাজ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকও টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির আমানতের প্রায় সবই লুটপাট হয়ে গেছে। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটি প্রচণ্ড আর্থিক সংকট পড়েছে। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এর মধ্যে সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তারাও ঋণ হিসেবে দেয়া অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি আকর্ষণীয় মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করত। এর মধ্যে ছিল টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (টিডিআর), মান্থলি ইনকাম ডিপোজিট, কোয়ার্টারলি ইনকাম ডিপোজিট, ডাবল বেনিফিট ডিপোজিট, ট্রিপল বেনিফিট ডিপোজিট, মান্থলি সেভিংস স্কিম, কোটিপতি স্কিমের মতো আকর্ষণীয় সঞ্চয়ী উপকরণ।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে বিআইএফসি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবন্ধন দেখে আমানতকারীরা এখানে টাকা রেখেছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি বলছে আমানতকারীদের টাকা দিতে পারবে না। তা হলে আমানতকারীদের এ অর্থের দায় কে নেবে?

তিনি আরও বলেন, লুটপাটের মাধ্যমে বিআইএফসিতে জনগণের রক্ষিত আমানত আত্মসাৎ করা হয়েছে। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করল? এসব প্রশ্নগুলো এসে যায়।

তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী বিআইএফসি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি কাজ করতে পারে। এক. একে অবসায়ন করে সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া টাকা আমানতকারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ উদ্ধার করা বেশ কঠিন। এ প্রক্রিয়ায় টাকা পাওয়া অনিশ্চিত। দুই. প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠন করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করে আর্থিক বাজারে একটি ভুল বার্তা গেছে। যে কারণে পিপলস লিজিংকে আবার পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিআইএফসির ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। এ মুহূর্তে আরও একটি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন করা হলে বাজারে আরও খারাপ বার্তা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ৮৪২ কোটি টাকা। মোট ঋণের মধ্যে ৯৬ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি থাকায় ইতোমধ্যে কুঋণে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে কোনো অর্থ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশই নামে-বেনামে নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ ৯৬২ কোটি ২২ লাখ টাকা। জালিয়াতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির মোট মূলধন ও রিজার্ভে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত লোকসান দেয়ায় আগের অর্জিত মুনাফা থেকে ৯৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা এখনও বিতরণ করতে পারেনি।

সূত্র জানায়, বিআইএফসির আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ২০১৭ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে অবসায়ন করতে চেয়েছিল। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন করতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। সে অনুযায়ী ওই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে আর অবসায়ন করা যায়নি। এর আগে ঋণ জালিয়াতির কারণে ২০১৬ সালে বিআইএফসি’র পর্ষদ ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ