ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতায় শিল্প উদ্যোক্তা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের মেয়াদি ঋণ আদায়ের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় তলানিতে নেমে গেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরুর পরের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) মেয়াদি ঋণের আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত প্রান্তিকের অবস্থা আরো নাজুক অবস্থানে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণেই মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের আদায়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
এটা ব্যাংকিং খাতকে সমস্যায় ফেললেও অর্থনীতির স্বার্থে ভালো হয়েছে। তবে, এটাও এখন আর ঢালাওভাবে দেয়া ঠিক হবে না বলে তিনি মনে করেন। আগামীতে এমন সুবিধা পেতে হলে ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রমাণ দিতে হবে, তারা প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত। ঋণ আদায় না হলে, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া, নতুন বিনিয়োগ দেয়া কিভাবে সম্ভব হবে এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তেমন কিছুই করার নেই, তবে আর্থিক খাতের সুশাসন ও অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতকে অপেক্ষা করতে হবে। চলমান অবস্থায়ই চললে হবে।
শিল্প ঋণ আদায়ের চিত্র নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা গিয়েছে, প্রতি তিন মাসে গড়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় হতো। গত বছরের এপ্রিল-জুন তিন মাসে মেয়াদি এ শিল্প ঋণ আদায় হয়েছিল ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। চলতি বছরে একই সময়ে তা ১০ হাজার কোটি টাকায় নেমে গেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি, তবে এ তিন মাসে ঋণ আদায় আরো কমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের যে কয়েকটি খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ করা হয় এর মধ্যে অন্যতম খাত হলো শিল্পের মেয়াদি ঋণ। এ খাতে ব্যাংক বড় অংকের বিনিয়োগ করে। আবার এ খাত থেকে সুদে আসলে আদায় হয়ও বেশি। বলা চলে, বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকের আয়ের বড় একটি অংশ আসে এ খাত থেকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা রয়েছেন, প্রকৃত পক্ষেই খারাপ অবস্থানে চলে গেছেন। কিন্তু ওষুধ, আইটি খাতের মতো আরো অনেক খাতে ব্যবসায়ীরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হননি। কিন্তু তারাও ঋণ পরিশোধ করছেন না। এর প্রধান কারণ হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঢালাওভাবে সবাইকে ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি করা যাবে না, এমন নির্দেশনার পর অনেকেই সুযোগ পেয়ে যান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর যারা ভালো অবস্থানে আছেন ঋণ পরিশোধ না করায় তাদেরকেও কোনো চাপ দেয়া যাচ্ছে না। ধরে নেয়া হয়েছিল তৃতীয় দায় আর সময় বাড়ানো হবে না, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্তই এ সুযোগ থাকবে। কিন্তু এ সুযোগ তৃতীয় দফায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ঢালাওভাবে না দিয়ে খাত অনুযায়ী দিলে ব্যাংকগুলোর কিছু আদায় বাড়তো। কিন্তু এ সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্যাংকগুলোর সামনে এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। তারা ডিসেম্বর প্রান্তিকে কিভাবে চলবেন, শেয়ারহোল্ডারদের কিভাবে লভ্যাংশ দেবেন এ নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
ব্যাংকারদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনে ব্যাংকিং খাতের বড় ধরনের দুর্দিন নেমে আসবে, এর প্রভাব পুরো অর্থনীতিকেই বহন করতে হবে বলে তারা মনে করছেন।