দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচার ঠেকাতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমদানিপণ্য যথাসময়ে দেশে না-এলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের নতুন এলসি খোলা সীমিত বা বন্ধ করে দেওয়া হবে। একইসঙ্গে রপ্তানিমূল্য দেশে না-এলে রপ্তানি খাতের কম সুদের ঋণসহ অন্যান্য প্রণোদনা মিলবে না। আমদানি বা রপ্তানির কোনো ক্ষেত্রেই শেল ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো এলসি স্থাপন করা যাবে না।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার বিষয়ে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার ঠেকানোর বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) তৈরি একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোয় পাঠানো হয়েছে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে তদারকি বাড়ানো এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এ কাজে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হলে তা আন্তঃসংস্থা ট্রাস্কফোর্সকে জানাতে হবে। তারা এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানির (বৈদেশিক বাণিজ্য) আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচারের সঙ্গে কোনো সরকারি কর্মকর্তা জড়িত থাকলে, সে ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জানাতে হবে। দুদক এ ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পাচারের প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তা প্রতিরোধের জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে যেসব টাকা পাচার হয়, এরসঙ্গে কোনো একটি পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের জড়িত করতে হয়। তাদের সহায়তা ছাড়া টাকা পাচার করা সম্ভব নয়। কেননা, পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় ব্যাংক, বন্দর, শুল্ক কর্তৃপক্ষের আওতায়। এসব নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারি কর্মকর্তারা। ফলে তাদের সহায়তা ছাড়া এই প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচার ঠেকানোর জন্য বিএফআইইউ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করছে। সেগুলো চাহিদা অনুযায়ী আরও অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো হচ্ছে। তারা সেসব বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের আরও একটি উপায় হচ্ছে আমদানিপণ্যের মূল্য বেশি দেখানো এবং রপ্তানিপণ্যের মূল্য কম দেখানো। এ প্রবণতা ঠেকাতে এখন তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারপরও টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। এ কারণে এ বিষয়গুলো আলোচ্য সংস্থার পাশাপাশি তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুদককে তথ্য সরবরাহ করতে। দুদক অভিযোগের প্রমাণ পেলে অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করবে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রতিরোধে এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর সমন্বিতভাবে কাজ করবে। আমদানি-রপ্তানির তথ্য তারা একে অপরের সঙ্গে আদান-প্রদান করবে। যাতে কোনো পর্যায়ে তথ্যের কোনো গরমিল না থাকে। বর্তমানে দুই সংস্থার মধ্যে তথ্যের যথাযথ আদান-প্রদান হয় না। ফলে আমদানি ও রপ্তানি তথ্যের মধ্যে অনেক গরমিল রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, টাকা পাচার যত বেশি বাড়বে বিভিন্ন সংস্থার কাছে থাকা আমদানি-রপ্তানির তথ্যের মধ্যে তত বেশি গরমিল হবে। তথ্যের গরমিল কমাতে হলে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। তাহলে পর্যায়ক্রমে গরমিল কমে যাবে। ব্যাংক থেকে আমদানিমূল্য পরিশোধের পরও যেসব পণ্য দেশে আসছে-না, সেগুলোর একটি ডেটাবেজ তৈরি করবে এনবিআর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগুলো দেখে পরবর্তী সময়ে তদারকি করবে। যেসব এলসির বিপরীতে পণ্য দেশে আসবে-না, সেসব গ্রাহককে নতুন এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।
একইসঙ্গে রপ্তানিমূল্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে না-এলে সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোরভাবে তদারকি করা হবে। মূল্য দেশে না-আনার কারণে রপ্তানির ক্ষেত্রে কম সুদের ঋণ সুবিধা মিলবে না। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার বন্ধে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করতে বিএফআইইউ এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করবে। ওই বৈঠকে এ বিষয়ে তাদেরকে আরও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হবে।
বর্তমানে শেল ব্যাংকের (যে ব্যাংকের কোনো দেশের নিবন্ধন আছে, কিন্তু কোনো অস্তিত্ব নেই, বিভিন্ন ধরনের ক্রেডিট ইউনিয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত) মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। এর মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। এ কারণে শেল ব্যাংকের এলসি গ্রহণ না-করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে শেল ব্যাংকের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন বা লেনদেন না-করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন এ বিষয়ে আরও বিশেষ নির্দেশনা জারি করবে বিএফআইইউ।
মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন কার্যক্রম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেল ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না-করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। এর আলোকে ২০২০ সালের ১৬ জুন বিএফআইইউ থেকে জারিকরা একটি সার্কুলারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় শেল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না-করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক শেল ব্যাংকিংয়ের এলসি গ্রহণ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব এলসির বিপরীতে রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। বিএফএআইউ এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা শনাক্ত করেছে। এগুলোর বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা নিচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচার ঠেকাতে বাণিজ্যবিষয়ক মানি লন্ডারিং গাইডলাইন জারি করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচার রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করে বিএফআইইউ। এতে আমদানিপণ্য ও রপ্তানিমূল্য যথাযথভাবে দেশে আসছে কি না, তা তদারকি করা হবে।
মানি লন্ডারিং আইন পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হবে। বর্তমানে জরিমানার পরিমাণ খুবই কম। জরিমানা বাড়িয়ে এসব অপরাধ ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।