মিনিকেট-নাজিরশাইল চাল অস্তিত্বহীন!

বাংলাদেশের বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে যে চাল বিক্রি হচ্ছে তা শতভাগই অস্তিত্বহীন। ব্যবসায়ী ও মিলাররা বিভিন্ন জাতের মোটা চাল সংগ্রহ করে মিনিকেট এবং নাজিরশাইল হিসেবে বিক্রি করছেন। বিপণনের আগে আধুনিক মেশিনে এগুলো প্রচুর পরিমাণে পালিশ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সরকারি গবেষণায় (বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট-ব্রি) এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ব্রি কর্তৃপক্ষের গবেষণাটি এখন আনুষ্ঠানিক প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

ব্রি কর্তৃপক্ষের খাদ্য পরিকল্পনা ও নিরীক্ষণ ইউনিটের গবেষণায় উচ্চ ধান উৎপাদন ও কলকারখানার জন্য নির্বাচিত ১৮টি জেলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রায় এক বছরব্যাপী (২০২০ সাল) চালানো গবেষণায় কৃষক, ধানের মিলার, ব্যবসায়ী ও কৃষি সম্প্রসারণ এবং বিপণন কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। মিনিকেট চাল তৈরির জন্য বিভিন্ন ধানকে উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ধানগুলো হলো- বিআরআরআই ২৮, ২৯ ও ৯০ ধান এবং জিরশাইল, জিরা, সাবলোটা, স্বর্ণা-৫ সহ বিভিন্ন জাতের সঙ্গে মাঝারি ও সূক্ষ্ম ধান।

গবেষণায় আরো জানা গেছে, নাজিরশাইল ধানের জন্য উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিআরআরআই ২৮, ২৯, ৩১, ৩৯, ৫১, ৪৮, ৪৯, ৮৫ এবং ৮৬ জাতের সাথে জিরাশাইল, স্বর্ণ, সোমকাটারি এবং পাইজাম জাতের ধান।

গবেষণাকালে রাইস মিলাররা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন জাতের ধান একসঙ্গে মিলিয়ে অটো মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করে ওই চাল ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন চালের নামের লেবেলযুক্ত বস্তাগুলো মিলে পাঠায়। মিলাররা কেবল তাদের মেলানো চাল দিয়ে বস্তা ভরে আবার তাদের কাছে ফেরত পাঠায়। এমনকি বস্তার মধ্যে কী ধরনের চাল তারা বিক্রি করছেন, সে সম্পর্কে খুচরা বিক্রেতারাও জানেন না। এ অবস্থায় মিলার ও চালের ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের প্রতারণা করার সময় উচ্চমূল্যে কম দামের চাল বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বাজারে খুব প্রভাব বিস্তার করেছে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল। এসব চালের জনপ্রিয়তায় দেশীয় জাতের চালের নাম ও চাহিদা হারাতে বসেছে। এরপর জনপ্রিয় এ চাল দুটির উৎস খুঁজে বের করতে মাঠে নামে বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ব্রি)। দীর্ঘদিন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইনস্টিটিউটের গবেষণা শাখা প্রমাণ পায় যে, মিনিকেট নামে কোনো ধানের অস্তিত্ব নেই। আর নাজিরশাইল জাতটির অস্তিত্ব থাকলেও দেশের সামগ্রিক ধানের আওতায় এর উৎপাদন এক শতাংশেরও কম। অথচ বাজারে বিক্রি হওয়া চালের প্রায় ৮০ শতাংশই মিনিকেট ও নাজিরশাইল হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের খাদ্যবিষয়ক সম্পাদক নাজমনারা খানম বলেন, গবেষণা করতে গিয়ে আমরা অবাক হয়েছি যে, বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের নামে কী খাচ্ছি। মানুষের পছন্দের ওপর পুঁজি করে ব্যবসায়ী এবং মিলাররা বিভিন্ন জাতের মোটা চাল সংগ্রহ করেন। মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করে সূক্ষ্ম সাদা চাল তৈরি করা হয়। মিনিকেট এবং নাজিরশাইল জাত হিসেবে বিপণনের আগে এগুলো প্রচুর পরিমাণে পোলিশ করা হয়। তাছাড়া এ কাজে আরো অনেক কৌশল অবলম্বন করা হয়, বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে সবাই জানতে পারবে। তিনি বলেন, দেশের জনগণকে আমরা আর এভাবে প্রতারিত হতে দেব না। এ অপব্যবহার বন্ধে চাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শিগগির অভিযানে নামব। আগে আমাদের অভ্যন্তরীণ সভায় গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে।

বিআরআরআই (ব্রি) গবেষণা পরিচালক কৃষ্ণপদ হালদার বলেন, সূক্ষ্ম ও সাদা ভাত আহারে জনপ্রিয়তায় একটি ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই দেশে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল আসে। ‘মিনিকেট’ নামটি ‘মিনি কিট’ থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এটি আসলে বীজ ও সারসহ চাল উৎপাদনের জন্য ভারতীয় কৃষকদের দেওয়া একটি প্যাকেজ।

কৃষ্ণপদের মতে, দিনাজপুরের কিছু কৃষক অজানা ভারতীয় ধানের জাতের চাষ শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো এটি চাষ করতে পারেন তবে পরিমাণটি খুব নগণ্য। বাংলাদেশে চাষাবাদ করা তথাকথিত মিনিকেট ও নাজির বিভিন্ন জাতের সামগ্রিক ধান উৎপাদনের ১ শতাংশেরও কম হয়। এ উৎপাদন দিয়ে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের চাহিদাও মেটানো সম্ভব নয়।

তিনি জানান, গত বছর মোট ধানের উৎপাদন ছিল ৩ দশমিক ৮৮৭ কোটি টন। যার মধ্যে ৬০০ থেকে ৭০০ শতাংশ মিনিকেট এবং ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নাজিরশাইল হিসেবে বিক্রি হয়েছিল। বাকিগুলো অন্যান্য নামে বিক্রি হয়েছে।

কৃষ্ণপদ বলেন, মিনিকেট বা নাজিরশাইল তৈরিতে চালের ওপর ওভার-পলিশিংয়ে প্রোটিন, অশোধিত ফাইবার এবং ছাইয়ের স্তরগুলো হ্রাস হয়। এতে চালের পুষ্টিগুণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ-জাতীয় মিল চালের কার্বোহাইড্রেটযুক্ত, ভিটামিন বি, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন ও নিয়াসিনকে পুরোপুরি সরিয়ে দেয় এবং চালের জিংকের পরিমাণ অর্ধেকের নিচে কমিয়ে দেয়। মিনিকেট চালের তুলনায় বিআরআরআই-২৮ চালে প্রোটিন, ফ্যাট, অপরিশোধিত ফাইবার এবং ছাই বেশি থাকে।

পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক সংস্থান জার্নালে প্রকাশিত ২০১৬ সালের গবেষণার উল্লেখ করা হয়েছে, মিলাররা শুঁটকি, পেরিকার্প (ফলত্বক), বীজ কোট, ভ্রুণ এবং জীবাণু বিভিন্ন জাতের চালের বিআরআরআই-২৮ বা ২৯ থেকে সম্পূর্ণ অপসারণের জন্য হোয়াইটনার এবং পলিশারসহ মেশিনগুলো ব্যবহার করে।

গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, এ মেশিনের মধ্যে ধানের অ্যাশের (ছাই) পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ভাতে কার্বোহাইড্রেট থাকে না। ফলে দ্রুত রক্তে আরো বেশি গ্লুকোজ নিঃসরণ করে, যা ডায়াবেটিসের মতো রোগের কারণ হতে পারে। চালে থাকা ফাইবারের উপাদানগুলো কার্যকরভাবে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এবং হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে। ফলে এতে ব্রেনে পাওয়া তেল সিরাম কোলেস্টেরল হ্রাস করে যা হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

বাংলাদেশ খাদ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুল কায়ওম সরকার বলেন, এভাবে চাল প্রক্রিয়াজাত করে  প্রতারণা, যা নিরাপদ খাদ্য এবং ভোক্তা অধিকার উভয় আইনেই এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্রি কর্তৃপক্ষের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হলেই অভিযানে নামবে তাদের টিম।

তিনি জানান, খাদ্য ভেজাল রোধে দেশে নিরাপদ খাদ্য আইনে জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে। খাদ্যে ভেজালকারী বা এ কাজে সহযোগীকে জেল বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের জেল এবং চার লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ