লাপাত্তা চাঁদায় পুষ্ট নেতারা!

  • সংকটে ৭১ লাখ পরিবহন শ্রমিক পরিবার
  • ১০ লাখ গাড়ি থেকে দৈনিক পাঁচ কোটি টাকা হারে করোনার ৯ মাসে চাঁদা আদায় হয়েছে এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা
  • ৩২০ কোটি টাকা গেছে শ্রমিক ফেডারেশনে, বাকি এক হাজার ৩০ কোটি অন্তর্ভুক্ত বেসিক ইউনিয়নে
  • শ্রমিকের নিয়োগপত্র, মাসিক বেতন, বেতনের প্রজ্ঞাপন মালিক সমিতি বাস্তবায়ন না করায় সরকারি অনুদান থেকেও বঞ্চিত শ্রমিকরা
  • থেকেও নেই কল্যাণ তহবিল,  বছরে চাঁদা তোলা হয় কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা

শত শত কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলো সংকট দেখা দিলেই যেনো লাপাত্তা হয়ে যায়। শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা যেনো ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে স্বাভাবিক সময়ে শ্রমিক কল্যাণের নামে চাঁদা আদায় করা শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। সড়ক পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, সংগঠন পরিচালন ব্যয় ও শ্রমিক কল্যাণের নামে স্বাভাবিক সময়ে বছরে কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়ে থাকে সড়কে। কিন্তু চলমান করোনা সংকটের প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে গত ৯ মাসে সড়কে চাঁদা আদায়ের পরিমাণ এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। যে চাঁদার ভাগ যাচ্ছে শ্রমিক ফেডারেশনেও।

তথ্যে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে ফেডারেশনের জন্যই দিনে কোটি টাকাও তোলা হয় শ্রমিক কল্যাণের নামে। কিন্তু শ্রমিক নেতা ও পরিবহন মালিক নেতারা শ্রমিকদের কাছ থেকে কল্যাণের নামে চাঁদা আদায় করলেও হালের সংকটে দেশের ৭১ লাখ পরিবহন শ্রমিকই পরিবার নিয়ে পিষ্ট হচ্ছেন অর্ধাহারে-অনাহারে। অথচ চাঁদার টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠা পরিবহন খাতের শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগই সংকটকালীন এই সময়ে নেই শ্রমিকদের পাশে।

সড়কে চাঁদা আদায়ের ধরন পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর দেশে করোনার অস্তিত্ব টের পাওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে লকডাউনে যায় দেশ, সবকিছুই বন্ধ থাকে ৩০ মে পর্যন্ত। সরকার পহেলা মে থেকে স্বল্প পরিসরে চালু করে গণপরিবহন, সেসময় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনায়ও বসেন বর্তমান পুলিশ প্রধান (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। সড়কে কোনো প্রকার চাঁদা আদায় করা যাবে না বলে বলেছিলেন তিনি। মালিক সমিতিও তখন রাজি হয়।

এর পরদিনই সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, সড়কে চাঁদা আদায় বন্ধে সরকারের সহযোগিতা চায় শ্রমিক ফেডারেশন। বিভিন্ন জায়গা থেকে গোপনে চাঁদা আদায়ের সময় কয়েকশ লোককে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এরা ছিলো ক্ষুদে চাঁদাবাজ। তবে গ্রেপ্তারের খবরে জুন-জুলাই দুই মাস চাঁদা আদায় বন্ধ থাকলেও ফের আগস্ট থেকে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং মালিক সমিতি নির্দেশিকা প্রণয়ন করে যে— মালিক সমিতি ৬০ টাকা, শ্রমিক সংগঠন ৫০ টাকা করে প্রতি গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করবে। এটা সংগঠন পরিচালন খরচ। গত বছরের আগস্ট থেকে এই ৯ মাসে মালিক সমিতি ৬০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৫০ টাকা, এর মধ্যে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ১০ টাকা এবং তাদের অন্তর্ভূক্ত বেসিক ইউনিয়নগুলো ৪০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে। অথচ কল্যাণের নামে আদায় করা চাঁদার টাকা নিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কোনো সংগঠনকেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখ। শ্রমিক ফেডারেশন ও মালিক সমিতি যে নির্দেশনা প্রণয়ন করেছিল সেখানে উল্লেখ আছে— একটি গাড়ি থেকে দৈনিক একবার চাঁদা নেবে, কিন্তু ঢাকা-কক্সবাজার যেতে একটি গাড়িকে কমপক্ষে ১৫টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এছাড়া কোনোটা ১০ বার, কোনোটা আটবারও চাঁদা দিচ্ছে। যেমন— ঢাকা-কুমিল্লা যেতে একটি গাড়িকে ছয়টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। যদি তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী একবার আদায় করা হয় ৫০ টাকা, সে হিসাবে ১০ লাখ গাড়ি থেকে প্রতিদিন আদায় হয় পাঁচ কোটি টাকা। এ টাকা থেকে এক কোটি টাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আর চার কোটি টাকা তার অন্তর্ভূক্ত বেসিক ইউনিয়নগুলোর। আগের হিসাব যেমন-তেমন, এই ৯ মাসের হিসাবে ফেডারেশন এবং তাদের অন্তর্ভূক্ত ২৫০টি ইউনিয়ন ১০ লাখ গাড়ি থেকে প্রতিদিন পাঁচ কোটি টাকা হারে চাঁদা আদায় করছে এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ টাকা থেকে ফেডারেশন পেয়েছে ৩২০ কোটি টাকা আর এক হাজার ৩০ কোটি  টাকা পেয়েছে তাদের অন্তর্ভূক্ত বেসিক ইউনিয়ন। অথচ এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা থেকে ১৩৫০ টাকার ত্রাণও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন দেয়নি।’

ত্রাণের বিষয়ে জানতে চেয়ে শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে শ্রমিক কল্যাণের জন্য যে চাঁদা পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে আদায় করে ফেডারেশন ও তার বেসিক ইউনিয়নগুলো, করোনা সংকটে শ্রমিকদের কল্যাণে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না ফেডারেশনকে এমন প্রশ্ন উল্লেখ করে  ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।

তিনি বলেন, ‘গত পাঁচদিন আগে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সাহেব মহাখালী টার্মিনালে ১২শ শ্রমিককে ত্রাণ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে আমরা পেরেছি, এর সংখ্যা পাঁচশ, ১২শ নয়।’ হানিফ খোকন বলেন, ‘১২শ লোককে ত্রাণ দিলেন কিন্তু বাকিরা কী করবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে এনায়েত উল্লাহ বলেছেন, ‘বাকিরা আমাদের সদস্য না। খন্দকার এনায়েত উল্লাহর এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হানিফ খোকন বলেন, ‘মহাখালী টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার গাড়ি আপডাউন করে। চার হাজার গাড়ির মধ্যে দুই শিফটে একটি গাড়িতে ছয়জন করে ১৪শ জন শ্রমিক ডিউটি করেন। অথচ ত্রাণ দিয়েছেন মাত্র ১২শ জনকে। আর বাংলাদেশে তাদের ভাষ্যে— ৭১ লাখ শ্রমিকের নেতা তারা। অথচ তারা ত্রাণ দিলো ১২শ জনকে। কিন্তু তাদের এক হাজার ৩৫০ কোটি যে চাঁদা, সেখান থেকে এক টাকাও দিলো না। ১২শ জনকে যেটা দিয়েছে সেটাও আবার সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ফান্ড থেকে।’

করোনাকালীন সময়েও শ্রমিক ফেডারেশন কিংবা মালিক সমিতি কোথাও যায়নি। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয়  ও জেলা কমিটি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সহায়তা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন হানিফ খোকন। তাদের কক্সবাজার জেলা কমিটি গত তিন-চার দিন আগেও পাঁচ শতাধিক পরিবহন শ্রমিককে, মৌলভীবাজার ও সাভারসহ বিভিন্ন শাখা কমিটির মাধ্যমেও ত্রাণ সহায়তা বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কোনো প্রকার চাঁদা তারা তুলেন না বলেও বলছেন তিনি।

চাঁদা আদায়ের ধরন পাল্টেছে জানিয়ে হানিফ খোকন বলেন, আগে চাঁদা শ্রমিক সংগঠনের নেতারা তাদের কর্মী দিয়ে চাঁদা তুলতো। কিন্তু এখন আর সেভাবে তুলে না। কাউন্টারেই চাঁদা আদায় হয়। সন্ধ্যাবেলায় হিসাব করে তাদের চাঁদা বুঝিয়ে দেয়া হয়। এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হয়। ঢাকায় কাউন্টারেই চাঁদা টাকা আদায় হলেও বিভিন্ন জেলায় বা বিভিন্ন জায়গা দেখা যায় এখনো কর্মীরা বসে থাকে চাঁদার জন্য। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের এখানেও মৃত এবং পঙ্গু শ্রমিকদের সাহায্যার্থে ২৫ টাকা করে উঠানো হয় প্রতি গাড়ি থেকে। এ রকম দেশের সব জায়গাতেই, কোনো জায়গায় ২৫ কোনো জায়গায় ৫০ কোনো জায়গায় ১০০ টাকা। এসব চাঁদাবাজির কোনো হিসাব নেই। কিন্তু শ্রমিকের কল্যাণে কাউকে খুেঁজ পাওয়া যাবে না।’

জানতে চাইলে হানিফ খোকন বলেন, ‘সর্বোপরি কথা সড়ক পরিবহন আইন এবং শ্রম আইনে আছে— মালিক কর্তৃক শ্রমিকের নিয়োগপত্র, মাসিক বেতন দেয়া, মাসিক বেতনের প্রজ্ঞাপনও হয়েছিল। মালিক সমিতি সেটা বাস্তবায়ন করেনি। আবার শ্রমিকের যদি শ্রম আইন অনুযায়ী মাসিক বেতন থাকতো তাহলে কিন্তু সরকার ভর্তুকি দিতে পারতো। যেমন— গতবার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ১৬৩ কোটি টাকা পরিবহন, নির্মাণ শ্রমিক ও হকারদের দেবেন। কিন্তু দেবে কোথায়, এদের তো নিয়োগপত্রই নেই, কাকে দেবে। যার জন্য পরিবহন শ্রমিকরা সরকারি অনুদান থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।’

এ নিয়ে জানতে চেয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে গণপরিবহন বন্ধ। এরই মধ্যে ঢাকা-কুমিল্লায় মাইক্রো-প্রাইভেটকার ভাড়া নিচ্ছে ৮০০ টাকা। কিন্তু প্রাইভেটকার পাচ্ছে ৬০ শতাংশ ভাড়া আর ৪০ শতাংশই নিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি টার্মিনালে থাকা শ্রমিক ইউনিয়েনের দালাল চক্র। সমগ্র বাংলাদেশে এভাবেই বাস বন্ধ থাকলেও চাঁদাবাজি থেমে নেই।

আমারসংবাদ/জেআই

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ