আতাউর রহমান খসরু
সৃষ্টির সময় থেকে মানবজাতির সঙ্গে শয়তানের শত্রুতার সূচনা। সে মহান আল্লাহর সামনে মানবজাতিকে সত্যচ্যুত করার অঙ্গীকার করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাকে অভিশাপ করেন এবং সে বলে, আমি অবশ্যই আপনার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেব। আমি তাদের পথভ্রষ্ট করবই।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১১৮-১১৯)
শয়তানের এই প্রতিশোধ-স্পৃহা থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে আল্লাহ বারবার তাদের সতর্ক করেছেন। নিষেধ করেছেন তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২১)
শয়তানের ‘পদাঙ্ক’ দ্বারা উদ্দেশ্য
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, শয়তানের ‘পদাঙ্ক’ দ্বারা উদ্দেশ্য তার পথ, কর্মপদ্ধতি আর সে যে কাজের নির্দেশ দেয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মতে, পদাঙ্ক দ্বারা শয়তানের কাজ উদ্দেশ্য। কাতাদা (রহ.) বলেন, প্রতিটি পাপের কাজই শয়তানের পদাঙ্কের অন্তর্ভুক্ত। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
শায়খ ইবনে উসাইমিন (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন এমন সব কাজই শয়তানের ‘পদাঙ্ক’-এর অন্তর্ভুক্ত; চাই তা অহংকার, মিথ্যা বলা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ ইত্যাদি যা-ই হোক। কেননা শয়তান তার নির্দেশ দেয়, তার প্রচার করে এবং তার দিকে আহ্বান জানায়।’ (তাফসিরুল ফাতিহা ওয়াল বাকারা : ২/২৩২)
শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ নিষিদ্ধ কেন?
পবিত্র কোরআনের ৪ স্থানে আল্লাহ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। এসব স্থানে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
১. শয়তান মানুষের শত্রু : শয়তান মানুষের শত্রু, সে মানুষের অনিষ্ট চায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৪২)
২. শয়তান অসৎ জীবনের পথ দেখায় : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কোরো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৬৮)
৩. আল্লাহর আনুগত্যে বাধা দেয় : শয়তান মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য করতে এবং তাঁর কাছে সর্বাত্মক আত্মসমর্পণ করতে নিষেধ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কোরো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২০৮)
৪. শয়তান অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয় : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে, শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২১)
শয়তান যেভাবে মানুষকে প্রতারণা করে
শয়তান মানুষকে নানাভাবে প্রতারণা করে। ফলে সে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। পবিত্র কোরআনে শয়তানের প্রতারণা করার নানা কৌশল বর্ণিত হয়েছে। তার কয়েকটি বর্ণনা করা হলো।
১. মিথ্যা আশা : শয়তান মানুষের মনে মিথ্যা আশা সৃষ্টি করে প্রতারিত করে। আল্লাহ বলেন, ‘সে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আসলে শয়তান তাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১২০)
২. মন্দ কাজকে শোভনীয় করে তোলে : শয়তান মানুষের মন্দ কাজকে সুন্দর ও শোভনীয় করে তোলে। ফলে মানুষ তা করতে দ্বিধা করে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘শয়তান মন্দ কাজগুলো তাদের দৃষ্টিতে চমৎকার ও মনোহর করে তোলে। এভাবে তাদের সরল-সঠিক পথ অবলম্বনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৩৮)
৩. মনে ভয় সৃষ্টি করে : শয়তান মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করে। ফলে সে ভালো কাজে অগ্রগামী হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় ও কৃপণতার আদেশ করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৮)
৪. নেশা ও মোহগ্রস্ত করে : শয়তান মানুষকে মাদক, জুয়া ও ভাগ্য নির্ণয়ের মতো পাপের প্রতি মোহগ্রস্ত করে তোলে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, জেনে রেখো, মদ, জুয়া, পূজার বেদি, ভাগ্য নির্ণয়ের শর—এসবই শয়তানের নোংরা কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৯০)
৫. লোভ দেখায় : লাভের আশা বা লোভ দেখিয়ে শয়তান মানুষকে অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সুদ খায় তারা অবশ্যই ওই ব্যক্তির মতো (কিয়ামতের দিন) দাঁড়াবে, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধি শূন্য করে দিয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
শয়তানের হাত থেকে আত্মরক্ষার উপায়
শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকা মুমিনের দায়িত্ব। শয়তানের হাত থেকে বাঁচতে কিছু করণীয় হলো—
১. শয়তানকে শত্রুজ্ঞান করা : আল্লাহ শয়তানকে শত্রুজ্ঞান করতে বলেছেন। যেন সে প্রতারণা করতে না পারে। ইরশাদ হয়েছে, ‘শয়তান তো তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কোরো।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ৬)
২. ঈমানের ওপর দৃঢ় থাকা : যে ব্যক্তি ঈমানের ওপর দৃঢ় থাকে এবং তাঁর ওপর আস্থা রাখে, আল্লাহ তাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তার কোনো আধিপত্য নাই তাদের ওপর যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকের ওপর নির্ভর করে।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ৯৯)
৩. আল্লাহর জিকির করা : আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হলে ব্যক্তির ওপর শয়তানের প্রভাব বাড়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘শয়তান তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, ফলে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত : ১৯)
৪. আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা : পবিত্র কোরআনে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলেছেন, ‘বলুন, হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা থেকে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৯৭)
৫. আল্লাহর অনুগত বান্দা হওয়া : আল্লাহর অনুগত বান্দারা শয়তানের প্রভাবমুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোনো ক্ষমতা থাকবে না।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ৪২)
আল্লাহ সবাইকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।