সে আগুন ছড়িয়ে গেল
নানা দেশে নানা ভাষায় বেবি শার্ক গানটির অসংখ্য সংস্করণ আছে। তবে ৮ দশমিক ৭ বিলিয়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে যে ভিডিওটি, সেটি পাবেন পিংকফং-এর ইউটিউব চ্যানেলে। পিংকফং মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্মার্টস্টাডির একটি ব্র্যান্ড।
২০১৫ সালে শুরুতে গানটির একটি অ্যানিমেশনভিত্তিক সংস্করণ আপলোড করেছিল পিংকফং। ২০১৬ সালে তারা নতুন করে গানটির অডিও ও ভিডিও ধারণ করে। দুটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ের সহজ নাচের ভঙ্গি, ঝলমলে রং, কিংবা গানের কম্পোজিশন, যে কারণেই হোক, বাচ্চারা এই সংস্করণটি পছন্দ করে ফেলে। ব্যস। ‘ডু ডু ডু ডু…’ যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিল, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।
কদিন আগে হঠাৎ করেই অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিল ‘কাকলী ফার্নিচার’ নামের একটি আসবাবপত্রের দোকানের বিজ্ঞাপন। নেটিজেনরা বলছিলেন, বিজ্ঞাপনটির ট্যাগ লাইন—‘দামে কম মানে ভালো’ কথাটা নাকি মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে! বেবি শার্কও ‘একই দোষে দুষ্ট’। কয়েকবার শুনলেই মাথার ভেতর ‘ডু ডু ডু ডু’ বাজতে থাকে!
কদিন আগে হঠাৎ করেই অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিল ‘কাকলী ফার্নিচার’ নামের একটি আসবাবপত্রের দোকানের বিজ্ঞাপন। নেটিজেনরা বলছিলেন, বিজ্ঞাপনটির ট্যাগ লাইন—‘দামে কম মানে ভালো’ কথাটা নাকি মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে! বেবি শার্কও ‘একই দোষে দুষ্ট’। কয়েকবার শুনলেই মাথার ভেতর ‘ডু ডু ডু ডু’ বাজতে থাকে!
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গানটির মূল রচয়িতা কে, কেউ জানে না। অনেকটা আমাদের দেশের ‘আকাশ থেকে নেমে এল ছোট্ট একটি প্লেন, সেই প্লেনে বসা ছিল লাল টুকটুক মেম’–এর মতো। বাচ্চারা খেলাচ্ছলে এই গান গায়, কিন্তু এর উৎপত্তি জানা নেই।
ধারণা করা হয়, ১৯৭০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের এক গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প থেকে মুখে মুখে ‘বেবি শার্ক’ গানটি ছড়িয়েছিল। আবার কেউ বলেন, ১৯৭৫ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের জ’স ছবিটি যখন তুমুল আলোড়ন তুলল, তখন ‘বেবি শার্ক’–এর জন্ম।
অনলাইনের দুনিয়ায় গানটি প্রথম পাওয়া যায় ২০০৭ সালে। ইউটিউবে জার্মান ভাষায় বেবি শার্ক গেয়ে আপলোড করেছিলেন এক নারী। ‘ক্লেইনার হাই’ শিরোনামের আবছা, অস্পষ্ট ভিডিওটি সে সময় খুব একটা পাত্তা (পড়ুন ভিউ) পায়নি।
এখানে দেখতে পারেন ‘ক্লেইনার হাই’ গানটি
বাচ্চা হাঙর বড় হলো
‘বেবি শার্ক’ রীতিমতো ‘অ্যাডাল্ট শার্ক’ হয়ে ওঠে ২০১৮ সালে। ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও এই গানে নাচতে শুরু করে টিকটকে #babysharkchallenge চালু হওয়ার পর। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায় বেবি শার্ক।
মার্কিন গায়ক জশ গ্রোবান থেকে শুরু করে বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ব্ল্যাকপিংকের সদস্যরাও বেবি শার্ক গেয়েছেন। ‘বাচ্চা হাঙর’–এর গানে মেতেছেন মার্কিন উপস্থাপক এলেন ডিজেনারেস থেকে শুরু করে বিখ্যাত ধনকুবের ইলন মাস্কও।
গত ২ জুন রকেট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক বেবি শার্কের ভিডিওটি টুইটারে শেয়ার করে লিখেছেন, ‘Baby Shark crushes all! More views than human!’ (বেবি শার্ক সব ভেঙেচুরে দিচ্ছে! মানুষের চেয়ে ভিউয়ের সংখ্যা বেশি!)
মজার ব্যাপার হলো, ইলন মাস্কের টুইটের পর বেবি শার্ক গানটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্মার্টস্টাডির শেয়ারের দাম রাতারাতি ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এক ‘বেবি শার্ক’ দিয়ে স্মার্টস্টাডি মোট কত আয় করেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বেবি শার্ক মার্চেন্টাইজের অধীনে তারা খেলনা, জামাকাপড়, মাছ ধরার সরঞ্জাম, এমনকি টিভি সিরিজও চালু করেছে।
স্মার্টস্টাডির আয়ের খুব সামান্য অংশের ধারণা পাওয়া যায় বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে। ‘বেবি শার্ক’ গানটির ভিউ যখন ৭০০ কোটি ছুঁয়েছে, তত দিনে শুধু ইউটিউব স্ট্রিম থেকেই তারা আয় করেছে ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৪৪ কোটি টাকা!
বাংলাদেশে বেবি শার্ক
মাহবীরের বয়স আড়াই বছর। ওর দ্বিতীয় জন্মদিনের অনুষ্ঠানে থিম ছিল বেবি শার্ক। মাহবীরের বাবা আবু হাসান বলছিলেন, ‘ছেলেটা এই গান এত পছন্দ করে! আমি আর আমার ছেলে বেবি শার্ক গান ছেড়ে নাচি।’
এ সময়ের অনেক বাবাই হয়তো আবু হাসানের সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পাবেন। ৭ মাস বয়সী ওয়ানিয়ার বাবা রাশিক আহমেদ বলছিলেন, ‘বেবি শার্ক হলো আমার মেয়ের কান্না বন্ধ করার ওষুধ। গানটা শুনলেই ওর মনোযোগ পুরোপুরি পর্দার দিকে চলে যায়।’
আবার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নিকিতা নুসরাত জানালেন, তাঁর মেয়ে শাইয়িন সাবাবা প্রায়ই মাকে ‘মাম্মি শার্ক’ বলে ডাকে।
বাংলাদেশে বেবি শার্ক আদতে কতখানি জনপ্রিয়? ‘আম পাতা জোড়া জোড়া’র দেশ থেকে ‘বাচ্চা হাঙর’–এর গান কয়বার দেখা হলো?
বিস্তারিত জানতে পিংকফংয়ের সঙ্গে ই–মেইলে যোগাযোগ করেছিলাম। উত্তরে প্রতিষ্ঠানটির যোগাযোগ কর্মকর্তা নাটালি জানালেন, প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতির কারণে দেশভেদে ভিউয়ের নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে যেসব দেশ থেকে পিংকফংয়ের ইউটিউব চ্যানেল ও তাদের অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন খুব দ্রুত বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
বিস্তারিত জানতে পিংকফংয়ের সঙ্গে ই–মেইলে যোগাযোগ করেছিলাম। উত্তরে প্রতিষ্ঠানটির যোগাযোগ কর্মকর্তা নাটালি জানালেন, প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতির কারণে দেশভেদে ভিউয়ের নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে যেসব দেশ থেকে পিংকফংয়ের ইউটিউব চ্যানেল ও তাদের অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন খুব দ্রুত বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
‘শার্ক’ দিয়ে মাছ ঢাকা
ঢাকার নিকেতনের বাসিন্দা মোহাম্মদ আশিক রহমান বলছিলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে আনমনেই বেবি শার্ক ডু ডু ডু ডু গাই।’ বাসায় ছোট বাচ্চা আছে যাঁদের, তাঁদের মধ্যে কারও কারও আরও গুরুতর অভিযোগ—এই গান নাকি ঘুমের মধ্যেও মাথায় ঘুরপাক খায়! সারাহ দেওয়ান নামে এক তরুণী বলছিলেন, ‘আমার ভাগনি সারা দিন এই গান শোনে। আমরা মোটামুটি বেবি শার্কের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। শার্ক শুনলে এখন আর হাঙর না, গানটাই চোখে ভাসে।’
এসব অভিযোগ কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ‘বেবি শার্ক’ কেন মাথায় আটকে যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণাও হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার থর্নটন স্কুল অব মিউজিকের সহযোগী অধ্যাপক বিট্রিজ ইলারি দীর্ঘদিন ধরে শিশুতোষ গান নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, একই সুরে একই কথা বারবার ঘুরেফিরে আসে বলেই গানটি মাথায় গেঁথে যায়।
বেবি শার্ক যখন শাস্তি
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় কয়েদিদের বেবি শার্ক শুনিয়ে ‘অত্যাচার’ করার অভিযোগও পাওয়া গিয়েছিল। জেলখানার কর্মীরা পাঁচ কয়েদিকে দেয়ালের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে টানা দুই ঘণ্টা বেবি শার্ক শোনার ‘শাস্তি’ দিয়েছিলেন।
তাই বলে বাচ্চা হাঙরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। মন ভালো করে দেওয়া ঘটনার জন্মও দিয়েছে বেবি শার্ক।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে গাড়ি করে বাড়ি ফেরার সময় সরকারবিরোধী একদল আন্দোলনকারীর মুখোমুখি পড়েছিলেন লেবাননের বাসিন্দা ইলিয়েন জেবার। সঙ্গে ছিল তাঁর ১৫ মাস বয়সী সন্তান। আন্দোলনকারীরা গাড়িটা ঘিরে ধরলে ইলিয়েন বলেন, ‘আপনাদের দেখে আমার বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে।’
ছোট্ট শিশুটির ভয় ভাঙাতে গাড়ি ঘিরে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বেবি শার্ক গাইতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। বাচ্চাটা সেই দৃশ্য দেখছিল অবাক হয়ে। এই ভিডিওটিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছিল।
ব্রিটিশ উপস্থাপক জেমস করডন একবার বলেছিলেন, ‘একটা গান একটা প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে। যে গান সবাইকে এক সুরে বাঁধে। যেমন জন লেননের ইমাজিন, মারভিন গেইজের হোয়াটস গোয়িং অন। কিন্তু এর আগে কোনো গানই কোনো প্রজন্মের চিত্রটা এত ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেনি…যেমনটা পেরেছে এ সময়ের “মডার্ন ক্ল্যাসিক”—বেবি শার্ক।’
কথাটা রসিকতা করে বলা। শুনে ‘দ্য লেট লেট শো উইথ জেমস করডন’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকেরাও হেসেছিলেন হো হো করে। কিন্তু হাসার আগে একবার ভেবে দেখতে পারেন, খুব কি ভুল বলেছেন তিনি?