সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে সাইবার অপরাধীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অ্যাপস ব্যবহার করে র্যাব বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধে জড়িত পাঁচ শতাধিক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত করে তাদের বিগত দিনের কর্মকাণ্ড যাছাই-বাছাই করছে। বর্তমানে চলছে অভিযানের প্রস্তুতি। একান্ত এক সাক্ষাত্কারে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন কালের কণ্ঠ’র সিনিয়র রিপোর্টার ওমর ফারুক
কালের কণ্ঠ : টিকটক, লাইকির ফাঁদে পড়ে কতসংখ্যক তরুণী পাচার হয়েছে? এর সঠিক তথ্য কি আপনাদের কাছে আছে?
র্যাব মহাপরিচালক : সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে বাংলাদেশের এক তরুণীকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ হৃদয় বাবুসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব আন্তর্জাতিক নারীপাচারচক্রের মূল হোতা রাফিসহ বেশ
কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার করাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ওই চক্র শুধু হৃদয় বাবুর মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, টিকটক বা লাইকির মতো অ্যাপসের ফাঁদে পা দিয়ে অনেক তরুণী পাচারের শিকার হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। র্যাবের গোয়েন্দা তথ্যসহ অন্যান্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, এ সংখ্যা নেহাত কম নয়। এমন আরো গ্রুপ থাকতে পারে। বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : টিকটক, লাইকির মতো অ্যাপসগুলো বন্ধ করার সময় এসেছে বলে আপনি বলেছেন, কোন প্রক্রিয়ায় এগুলো বন্ধ করা হবে? বন্ধ করতে না পারলে অপরাধ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
র্যাব মহাপরিচালক : টিকটক, লাইকির মতো অ্যাপস ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর জন্য বিটিআরসির সহযোগিতায় অ্যাপসগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন। অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করা না গেলে বিটিআরসি বাংলাদেশ থেকে টিকটক ও লাইকির মতো ক্ষতিকারক অ্যাপসগুলো বন্ধ করতে পারে।
কালের কণ্ঠ : শুধু দেশ থেকে নয়, বিদেশ থেকেও এসব অ্যাপ ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এগুলো রোধে র্যাবের ভূমিকা কী?
র্যাব মহাপরিচালক : বেশ কিছু দুষ্কৃতকারী বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপস ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে যারা ক্ষতিকর অ্যাপের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে র্যাব সাইবার মনিটরিং সেলের ২৪ ঘণ্টা গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা এসব অপপ্রচারে যুক্ত তাদের শনাক্ত করে নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আর যারা দেশের বাইরে থেকে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদেরকেও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে অপরাধীর অবস্থান করা দেশের সরকার ও ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : এসব অ্যাপসে অপরাধ রোধে র্যাবের সক্ষমতা কতটুকু?
র্যাব মহাপরিচালক : টিকটক, লাইকিসহ অন্যান্য অ্যাপসের মাধ্যমে যে দুষ্কৃতকারীচক্র নারীপাচার, প্রতারণাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত রয়েছে র্যাব তাদের শনাক্ত করে সাইবার নজরদারিতে রাখছে। এরই মধ্যে র্যাব এ ধরনের পাঁচ শতাধিক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত করেছে। তথ্যগুলো যাছাই শেষে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। র্যাব সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়াও চলমান।
কালের কণ্ঠ : অনলাইনে যারা অপরাধে জড়াচ্ছে তাদের অভিভাবকদের বিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?
র্যাব মহাপরিচালক : শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টায় সাইবার বা অনলাইন অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অভিভাবকদের পাশাপাশি কিশোর ও যুবসমাজকে সুপথে রাখতে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিসহ সকল স্টেক হোল্ডারকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
কালের কণ্ঠ : অনলাইনে যারা অপরাধ করছে তাদের তালিকা করার কথা বলেছেন, তালিকার কাজ কত দূর এগিয়েছে?
র্যাব মহাপরিচালক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশজুড়ে তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে যোগাযোগ, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য অনেক সেবা। কিছু দুষ্কৃতকারী এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা, সাইবার বুলিং, হ্যাকিং, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো সাইবার অপরাধ করছে। এই অপরাধীদের তালিকা তৈরি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিয়মিত এ তালিকা হালনাগাদ করে। নিত্যনতুন অপরাধীদের নজরদারিতে আনার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আপনি র্যাবের ডিজি হিসেবে যোগদানের পর র্যাবে কী কী পরিবর্তন হয়েছে?
র্যাব মহাপরিচালক : করোনা মহামারি শুরু হওয়ার সময় আমি র্যাব মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করি। প্রাণঘাতী এই মহামারির দুঃসময়ে নিজ বাহিনীর সদস্যদের সংক্রমণ রোধ থেকে শুরু করে সরকার ঘোষিত লকডাউন বাস্তবায়ন এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই ছিল র্যাবের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে র্যাব সর্বোচ্চ পেশাদারির মাধ্যমে কাজ করেছে। পাশাপাশি জঙ্গি, মাদক, সন্ত্রাসসহ অন্য অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে র্যাবের নিরবচ্ছিন্ন অভিযান চলমান ছিল। জঙ্গিবাদ দূর করতে র্যাব ফোর্সেস ভুল বুঝতে পারা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ডি-রেডিক্যালাইজেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন প্রক্রিয়ায় র্যাব ৯ জন উগ্রবাদীর মানসিক পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া মাদক কারবারি, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, মুনাফা লোভী কলোবাজারিচক্রের বিরুদ্ধে র্যাবের অবস্থান অন্য সময়ের চেয়ে অত্যন্ত দৃঢ় ও শক্তিশালী ছিল। ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে র্যাবের রয়েছে জল, স্থল ও আকাশপথে নিরাপত্তা প্রদানের সক্ষমতা। র্যাবকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সুবিধার আওতায় এনে আরো শক্তিশালী ও সময়োপযোগী করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সম্প্রতি Onsite Indentification and Verification System (OIVS) চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালনার জন্য র্যাবের রয়েছে স্পেশাল ফোর্স, ডগ স্কোয়াড এবং হেলিকপ্টার। সময়োপযোগী ও সফল অভিযান পরিচালনার জন্য এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। সেবা প্রাপ্তি সহজ করতে ‘রিপোর্ট টু র্যাব’ অ্যাপসের পাশাপাশি জনসাধারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব অভিযোগ করছে তা যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এই সুসংগঠিত বাহিনীর সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে সময়োপযোগী একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করব।
কালের কণ্ঠ : অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে অপরাধ দমনে কিভাবে সমন্বয় করছে র্যাব?
র্যাব মহাপরিচালক : র্যাব সদর দপ্তর কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধ দমনে আমরা নিজেদের গোয়েন্দা তথ্যের পাশাপাশি অন্য গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে অভিযান পরিচালনা করি। পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন অপরাধবিষয়ক সংবাদগুলো যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
কালের কণ্ঠ : র্যাবের আধুনিকায়নে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
র্যাব মহাপরিচালক : বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত এই এলিট ফোর্স বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও একটি মডেল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। র্যাব ফোর্সেসের প্রতিটি সদস্যের কর্মদক্ষতা ও অসীম সাহসিকতা দেশবাসীর আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে। সামনের দিনগুলোতে সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা আমরা অব্যাহত রাখতে চাই। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সুবিধাসহ সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে র্যাবের সার্বিক সক্ষমতা অর্জন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে র্যাব সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে মানুষের কল্যাণে সব সময় কাজ করে যাবে।