নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে শিশুসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ। এ ছাড়া দুই শতাধিক ব্যক্তি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। বিস্ফোরণে আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর তিন তলাবিশিষ্ট মগবাজার প্লাজা ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার আরও কয়েকটি বহুতল ভবন। বিস্ফোরণে আশপাশের বিভিন্ন ভবনের কাচ চৌচির হয়ে ভেঙে পড়ে রাস্তায়। একই সময়ে রাস্তার ওপর বিকট শব্দে যাত্রীবাহী দুটি বাসের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাস দুটির প্রায় সব যাত্রী কম-বেশি আহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তেই আগুনের ঝলকানি আর মানুষের আর্তনাদে সৃষ্টি হয় এক ভয়ংকর পরিস্থিতির। ভবনের সামনের সড়কে কাতরাতে থাকে অসংখ্য মানুষ। পড়ে থাকে নিথর দেহ। তাদের প্রত্যেকের শরীর ছিল আগুনে পোড়া। বিধ্বস্ত মগবাজার প্লাজার ভাঙা দেয়ালের পাশে আটকে পড়া মানুষ ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে তখন চিৎকার করছিল। ঘটনার পর রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি, এখানে যে শর্মা হাউস ছিল, মূলত সেখান থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে খুব সম্ভবত গ্যাস জমেছিল এবং এই গ্যাস বিস্ফোরণের কারণে আশপাশের সাতটি বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনটি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা সাতজন মারা গেছে বলে খবর পেয়েছি। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা নেই জানিয়ে বলেন, ‘যদি জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকত, তাহলে ঘটনাস্থলে স্পিন্টার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত এবং মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত। এটা গ্যাস চেম্বার থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে সঠিক কারণ ফায়ার সার্ভিসের তদন্তের পর জানা যাবে। এর আগে রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢামেকে তিনজন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন। পরে রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢামেকে চিকিৎসাধীন স্বপন (৩৫) নামে একজনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। এ ছাড়া বড় মগবাজার ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে তাইয়েবা নামের একটি শিশু ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের মেডিকেল সুপারভাইজার স্বাধীন। কমিউনিটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. শাহপরান বলেন, দুর্ঘটনার পর আহত হয়ে দুই শতাধিক মানুষ এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ৬০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের প্রথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কীভাবে এ বিস্ফোরণ তা জানতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে এই দুর্ঘটনা। ভবনের নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান ছিল। দ্বিতীয় তলায় একটা শোরুম ছিল। সেখানে ফ্রিজ ছিল। তিন তলায় ছিল একটি স্টুডিও। ভবনের সামনের সড়কে কাজ চলছে। সেখানেও গ্যাস ও ইলেকট্রনিক তার রয়েছে। কীভাবে এ বিস্ফোরণ তা তাৎক্ষণিক নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। বিধ্বস্ত ভবনের বাইরে ও ভিতর থেকে একে একে মৃতদেহ বের করে নিয়ে আসে উদ্ধারকর্মীরা। গুরুতর আহত কেউ কেউ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ও আদ্ব-দীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কেবল ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগেই নেওয়া হয় ৩৯ জনকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসময় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রমনা ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার ফয়সালুর রহমান বলেন, বায়োগ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ ও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে এখনো নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। জানা গেছে, ঘটনাস্থলের পাশেই রয়েছে রাশমনো হসপিটাল, বিশাল সেন্টার মার্কেট, উজ্জ্বল হোটেল, আগোরা ও আড়ংয়ের শো-রুম। বিস্ফোরণের ঘটনায় এসব স্থাপনারও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকট শব্দে বিস্ফোরণে মগবাজার প্লাজার ভবনের দেয়াল, আড়ং বিল্ডিং ও দুটি বাস বিধ্বস্ত হয়েছে। রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল কাচের টুকরো। চারদিকে হাজার হাজার লোকজন ভিড় করে। অনেক মানুষের আহাজারি। আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল। বিস্ফোরিত ওই ভবনের আশপাশের ভবনে অনেক লোক আটকা পড়ে। পথচারী ও গাড়িতে থাকা অনেকেই আহত হন। বিস্ফোরণের শব্দে সড়কে থাকা দুটি গাড়ির কাচ ভেঙে পড়ে রাস্তায়। স্থানীয়রা জানান, ঘটনাস্থলে কয়েক দিন ধরে ড্রেনের সংস্কার কাজ চলছে। তৎসংলগ্ন এলাকায় গ্যাস পাইপ লাইনের সংযোগের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বিস্ফোরণের পর ওই এলাকায় বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো মগবাজার এলাকা। পরে আবার বিদ্যুৎ ফিরে আসে। বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের লোক ঘটনাস্থলে যায়। বৈদ্যুতিক সংযোগজনিত কারণে এ বিস্ফোরণ ঘটেনি বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। ঘটনার পর কিছুক্ষণের জন্য ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে আবার চালু করা হয়। ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মগবাজারে বিস্ফোরণে ঘটনায় ঢামেকে চিকিৎসাধীন তিনজনের অবস্থা গুরুতর। আহতদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ ইকবাল হোসেন, শাহ আলম, কালু, কামাল হোসেন, লাকি বেগম, তার মা সালেহা, ছেলে সৈকত ও নিহিত, মাসুদ, শহীদ, সেন্টুসহ অনেকে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন রাত ১০টার দিকে জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় মোট ১৭ জনকে সেখানে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে দুজন মৃত ছিলেন। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, বিস্ফোরণে মগবাজার আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর তিন তলাবিশিষ্ট মগবাজার প্লাজা ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। এদিকে বিস্ফোরণে আহতদের স্বজনদের ছোটাছুটি আর কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। কিছুক্ষণ পরপর সাইরেন বাজিয়ে মগবাজার থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসে আহতদের নিয়ে। গত রাতে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে হাসপাতালটিতে। আহতদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামতেই স্বজনদের ছোটাছুটি শুরু হয়। তাদের আহাজারি ও কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।