নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া
কিশোর গ্যাং এখন সমাজে ব্যাধির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরূপে দেখা দিচ্ছে। চুরি-ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা, সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার মতো হিংস্র ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে। কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র বা নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটাচ্ছে হত্যাকান্ড। জমি দখল, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে এ আশায় স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করছেন। অভিযোগ রয়েছে, দলীয় আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে এ চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এসব কিশোর-তরুণ দেশের বাইরে থেকে আনছে লেটেস্ট স্টেজ অব ড্রাগ (এলএসডি)। এই নতুন মাদকের মূল ক্রেতা ছাত্র এবং অভিজাত পরিবারের সন্তানরাই। এ ড্রাগ সেবনের পর শিহরণরত অবস্থায় তারা সব ধরনের অপকর্ম করছে; নেশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহননের পথও বেছে নেয় কেউ কেউ।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়সসীমা ১২-১৭ বছরের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এরা একটি নির্দিষ্ট নাম ও লোগো শরীরে ট্যাটু করে অথবা দেয়ালে লিখে ব্যবহার করে এবং নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে। আমাদের পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য ব্যক্তিত্ব ইত্যাদিও গ্যাং কালচারের জন্য দায়ী। কমিউনিটিতে মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানরা একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার জন্য, নেশাগ্রস্ত পরিবার ইত্যাদিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে। স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হলে, ক্রমাগত শিক্ষকের বঞ্চনা, খারাপ ফলাফল, বন্ধু-বান্ধব অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, মাদক সেবনের প্রবণতা থাকলে, সহপাঠী দ্বারা বিদ্রুপের শিকার দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে, হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা, অনুকরণপ্রবণতা, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি ইত্যাদি কারণেও কিশোর গ্যাং গড়ে উঠে।
মূলত ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তরায় সড়কের উপর আদনান কবিরকে(১৪) সংঘবদ্ধ গ্যাং মারাত্মকভাবে কুপিয়ে হত্যাকান্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার নির্মমতা জনসম্মুখে উন্মোচিত করে। বরগুনার নয়ন বন্ড তার ০০৭ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা করলে দেশব্যাপী আবারও কিশোর গ্যাংয়ের বর্বরতা সামনে আসে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে চট্টগ্রামের জামালখান মোড়ে স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে খুন করে গ্যাং সদস্যরা। গতবছর ৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার জেরে কিশোরদের দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়ার বিরোধ মেটাতে গেলে মনিহারি ব্যবসায়ী লোকমান রনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত বছরের ২৬ আগস্ট চট্টগ্রামে খুন হয় দশম শ্রেণির ছাত্র জাকির হোসেন (সানি)। গত বছরের ১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আহাদ আলম শুভ মিয়া নামের এক যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা এবং ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় দুই শিক্ষার্থী। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে সাত বছর বয়সি শিশুসন্তানের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দিন নামের এক যুবককে। হত্যাকারী সুমনের গ্যাং সদস্যদের ‘গডফাদার’ সাবেক এমপি এমএ আউয়ালের পরিকল্পানায় এ হত্যাকান্ড ঘটে বলে ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশব্যাপী শত শত কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। করোনাকালেও তারা মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ পরিচালনা করছে।
এখনকার কিশোরেরা মা-বাবার সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছে, মা-বাবাকে খুনের ঘটনাও এখন মামুলি। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নির্দ্বিধায় একের পর এক অন্যায় করেও তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বড় কোনো শাস্তির পরিবর্তে তাদের পাঠানো হচ্ছে গাজীপুরে কিশোর শোধনাগারে।
শিশু-কিশোরদের মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে অভিভাবকদের যত্নবান হওয়া, ছেলেমেয়েকে উঠতি বয়সে কী করছে না করছে সব সময় খোঁজখবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে সময় দিয়ে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করার পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, বির্তক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন আয়োজনের ব্যবস্থা করা, স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনসহ শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখা, গণমাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও অনুষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি সুবিধা বঞ্চিত, দরিদ্র শিশু-কিশোরদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা, কিশোর গ্যাং নির্মূলে গ্যাং হটস্পর্টগুলো চিহ্নিত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা থেকে বিরত থাকা, পাড়া-মহল্লায় কমিটি গঠন করে জনসচেতনা বৃদ্ধি করা, জুম্মার খুৎবায় কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে বক্তব্য দেয়া, কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠিয়ে নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকভাবে সংশোধনের ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়া ব্যতীত অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারে সেই ব্যাপারে অভিভাবকদের সর্তক থাকতে হবে।
আমাদের দেশে পর্যাপ্ত কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নেই। গাজীপুরে দুটি এবং যশোরে একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য। সব মিলিয়ে এ তিনটির ধারণক্ষমতা মাত্র ৬০০ জনের। এ কারণে আটক শিশুদের বড় একটি অংশের উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না, তাই কারাগারেই থাকে। আবার আদালতের নির্দেশে কোনো কিশোরকে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কিছুদিন পর সে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কোনো ধরনের অপরাধ বড় রূপ নেওয়ার আগে অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে। এভাবে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিলে এবং উন্নয়নমূলক কাজের দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং নামক দুঃস্বপ্নের আধিপত্য কমে যাবে বলে আশা করা যায়।