ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১২০৩ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত ৫৫৪ বছর মুসলমান শাসকরা বাংলা শাসন করেন। সুদীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের মনে থাকা মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। একমাত্র রাজা গণেশ (১৪১৪-১৪১৬) ব্যতীত আর কোনো হিন্দু নেতা মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে অস্র হাতে নেয়নি। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতা করার মাধ্যমে হিন্দুদের অন্তরে শত শত বছর ধরে জমে থাকা মুসলিম বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
পলাশী যুদ্ধের পরই অসংগঠিত অবস্থাতেও বাংলার মুসলমানরা দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। লুণ্ঠিত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের এই লড়াইয়ে মুসলমানদের সহযোগিতার পরিবর্তে হিন্দু সমাজপতিরা উল্টো বিরোধিতা করেন। কারণ ইংরেজ শাসনকে সেদিন তারা ভগবানের আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করেন। এজন্য লর্ড রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে সমৃদ্ধ বাংলার বিপুল ধন-সম্পদ লুণ্ঠনে তারা সমর্থন দিয়েছিলেন। এই লুণ্ঠন সম্পর্কে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তার ‘ডিসকভারী অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘পলাশী যুদ্ধের পর বাংলা থেকে লুণ্ঠিত বিপুল পরিমাণে অর্থ সম্পদ দিয়ে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের সূচনা করা হয়।’

খাজনা আদায়ের নামে ইংরেজদের সীমাহীন শোষণ ও লুণ্ঠনের ফলে খাদ্যে উদ্বৃত্ত বাংলায় ১৭৭০ সালে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় (বঙ্গাব্দ এগারো’শ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) তাতে প্রতি তিনজনে একজন অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মানুষ অনাহারে মারা যায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের অর্থ সাহায্য দেয়ার কারণে মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবদমিত করতে দুর্ভিক্ষের ২৩ বছর পর ১৭৭৩ সালে গভর্নর জেনারেল (১৭৮৬-১৭৯৩) লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এর ফলে মুসলমানদের পরিণতি সম্পর্কে ‘ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার’ তার ‘দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমান’স’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির নগণ্য পদে যে সব হিন্দু নিয়োজিত ছিল, তারা জমিতে মালিকানা-স্বত্ব লাভ করলো এবং পূর্বে যে অর্থ মুসলমানদের ঘরে যেত সেই সব অর্থ হিন্দুরা আত্মসাৎ করতে লাগলো।’ উক্ত গ্রন্থে হান্টার আরও বলেছেন, ‘পলাশী যুদ্ধের পূর্বে বাংলার একজন মুসলমানের গরীব থাকাটা ছিল অসম্ভব এক ব্যাপার। আর পলাশী যুদ্ধের ৫০ বছর পর একজন মুসলমানের ধনী থাকাটা এক অসম্ভব ব্যাপার।’

দখলদার ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগী হিন্দুদের মিলিত ষড়যন্ত্রের ফলে পলাশী যুদ্ধের ৫০ বছরের মধ্যে বাংলার মুসলিম জমিদাররা এবং সচ্ছল মুসলিম কৃষক সমাজ জমির মালিকানা হারিয়ে নব্য হিন্দু জমিদারদের অনুগ্রহের পাত্র হয়ে পড়ে। কৃষকরা পরিণত হয় ভূমিদাসে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভাঙা কুঁড়ে ঘরে বসবাসকারী নিঃস্ব ও হতদরিদ্র ৯০ শতাংশ মুসলিম কৃষকের পরিধেয় বস্ত্র ছিল লেংটি ও গামছা। এরাই আমাদের হতভাগা পূর্ব পুরুষ।
বাংলার মুসলমানদের এমন দুর্দিনে খাজা পরিবারের ব্যবসায়ী খাজা হাফিজুল্লাহ সিলেট থেকে এসে ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি ময়মনসিংহের ইটনা পরগনা, ত্রিপুরা জেলাধীন বরদাখাত ও ফুলঝুরি এবং বরিশালে জমিদারী ক্রয় করেন। এই পরিবারের আরেক কীর্তিমান পুরুষ আবদুল গনী (১৮১৩-১৮৯৬) পারিবারিক জমিদারী আরও বিস্তৃত করেন। তিনি ঢাকার পলাশী, নীলক্ষেত ও শাহবাগে এবং তদীয় পুত্র খাজা আহছানউল্ল্যাহ (১৮৮৪-১৯০১) দিলখুশায় জমি ক্রয় করে খাজা এস্টেটের সাথে যুক্ত করেন। নবাব আবদুল গনী শাহবাগে ‘ইশরাত মঞ্জিল’ (১৯০৬ সালে যেখানে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা সভা হয়, বর্তমান মধুর ক্যান্টিন) নামে একটি বাগানবাড়ী ও চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বুড়িগঙ্গার তীরে মনোরম একটি প্রাসাদ খাজা আবদুল গনীর পিতা খাজা আলীমুল্লাহ ফরাসীদের নিকট থেকে ক্রয় করেছিলেন। ১৮৭২ সালে তা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করে খাজা আব্দুল গনী নিজ পুত্রের নামে প্রাসাদের নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’। ব্রিটিশ সরকার খাজা আব্দুল গনীকে ১৮৭৫ সালে নবাব খেতাব প্রদান করে এবং খাজা পরিবারের নবাবদের জ্যেষ্ঠপুত্র ওয়ারিস সূত্রে নবাব পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন বলে ১৮৭৭ সালে এক ফরমান জারী করে। খাজা পরিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, খাজা এস্টেটের মোতুওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করবেন নবাবগণ। ফলে নবাব আহছানউল্ল্যাহর ইন্তেকালের পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) ১৯০১ সালে নবাব এবং খাজা এস্টেটের মতুওয়াল্লী হন।

ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তাবে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের জন্য নবাব সলিমুল্লাহ পলাশীতে জমি দান করেন। স্কুলটি পিতা নবাব আহছানউল্ল্যাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল নামে নামকরণের জন্য তিনি ১৯০৮ সালে নগদ এক লক্ষ বিশ হাজার টাকাসহ আরও কিছু জমি দান করেন। পরে স্কুলটি কলেজে উন্নীত হয়। ১৯৬২ সালে কলেজটি পরিণত হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাধীনতার পর যার নামকরণ হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। খাজা এস্টেট ব্যতীত পলাশীতে সেদিন অন্য কোনো ব্যক্তির কোনো জমি ছিল না। বর্তমান বুয়েট নির্মিত হয়েছে নবাব সলিমুল্লাহর দান করা খাজা এস্টেটের জমিতেই।

শাসন শোষণের সুবিধা ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার বিশাল বাংলাকে ভাগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯০৫ সালের ২০ অক্টোবর তা কার্যকর করে গঠন করা হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। নতুন প্রদেশের তিন কোটি দশ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে এক কোটি আশি লক্ষ মুসলিম, এক কোটি বিশ লক্ষ হিন্দু ও অবশিষ্ট দশ লক্ষ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও নৃগোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন। নতুন প্রদেশের পশ্চাৎপদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা বিভিন্নভাবে উন্নত হয়ে হিন্দুদের সমকক্ষ হয়ে দাঁড়াবে- এটা উপলব্ধি করেই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতা ও সমাজপতিরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে শোরগোল সৃষ্টি করেন। তাদের বিরোধিতার ব্যাপারে তফসিলি নেতা ড. বি. আর আম্বেদকার তার ‘পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাংলা ভাগের ব্যাপারে হিন্দুদের এই বিরোধিতার মুখ্য কারণ হচ্ছে পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে তাদের ন্যায্য অংশ প্রাপ্তিতে বাধা দেয়া।’ সেসময় তাদের বঙ্গমাতার অঙ্গহানি মানি না নীতি যে ভন্ডামি ছিল তা পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে অখন্ড বাংলার প্রশ্নে বাংলা ভাগের পক্ষে থাকাই বড় প্রমাণ।

কলকাতা প্রবাসী বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত পূর্ববঙ্গের হিন্দু জমিদাররা তাদের জমিদারী রক্ষা করাসহ মুসলিম রায়তদের উপর প্রভূত্ব বজায় রাখার স্বার্থে কুষ্টিয়ার জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হলেও মূর্তিপূজা হতো না। কারণ পরিবারটি ছিল নিরাকার এক ব্রহ্মার উপাসক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূর্তিপূজারী ছিলেন না। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কোলকাতার হিন্দুদের সম্পৃক্ত করতে ১৯০৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কালীঘাটের কালীমন্দিরে পূজা দেয়া শেষে তিনি বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। এই আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলনে পরিণত হয় এবং পরিশেষে সূর্যসেনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সম্পর্কে ‘বিমলানন্দ শাসমল’ তার ‘ভারত কি করে ভাগ হল’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলিমবিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনের তাগিদে যে সকল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন তারা সকলেই ছিলেন গভীরভাবে মুসলিম বিরোধী।’

ভারতীয় কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করলে তা সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করে। অন্যদিকে নতুন প্রদেশের প্রতি ভারতের মুসলিম নেতাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য নবাব সলিমুল্লাহ নিজ অর্থ ব্যয় করে ঢাকার শাহবাগে ইশরাত মঞ্জিলের খোলা ময়দানে ২৭-২৯ ডিসেম্বর, ১৯০৬ আয়োজন করেন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স’ এর বিশতম অধিবেশনের। সর্ব ভারত থেকে আগত দুই হাজার প্রতিনিধি নতুন প্রদেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। কংগ্রেসকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পূর্ব পরিকল্পনা মতে, ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহর উত্থাপিত ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

সর্বভারতীয় হিন্দু নেতাদের অব্যাহত আন্দোলন ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ব্রিটিশ সরকার। বিনিময়ে রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরের শর্তটি বাংলার হিন্দু নেতারা মেনে নিলে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীর দরবার হলে বঙ্গভঙ্গ রহিত করেন। রাজধানীর বিনিময়ে বঙ্গভঙ্গ রহিত করার আনন্দে হিন্দুরা উল্লাসিত হলেও বাংলার মুসলমানরা ইংরেজ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এই ক্ষোভ যেন পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে পরিণত হতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতা নবাব সলিমুল্লাহর সাথে আলোচনা করার জন্য ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৯১০-১৯১৬) ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। সদ্য বিলুপ্ত হওয়া পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে আলোচনায় অংশ নেয়া ১৯ সদস্যের মুসলিম প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন, ধনবাড়ীর জমিদার সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও এ.কে ফজলুল হক। তারা কিছু দাবি লিখিত আকারে পেশ করেন। মুসলিম প্রতিনিধিদের কাছে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত জানান। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর ‘হিজ হাইনেস দি আগা খানের’ নেতৃত্বে নবাব ভিকারুল মূলক, সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, এ.কে ফজলুল হকসহ সর্ব-ভারতের ৩৫ জন মুসলিম নেতা সিমলায় ভাইসরয় (১৯০৫) লর্ড দ্বিতীয় মিন্টোর সাথে সাক্ষাত করে যে পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছিলেন তার শেষ দাবিটি ছিল, ‘মুসলিমদের ধর্মীয় ও বুদ্ধিগত জীবনের কেন্দ্র রূপে একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।’ এরপর ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরের শাহবাগ সম্মেলনেও অনুরূপ দাবি করা হয়। এই দাবির ধারাবাহিকতায়ই ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি ঘোষণার পর হিন্দু নেতারা নতুন করে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বাংলার চাষা-ভূষা মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই দাবি করে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কোলকাতার হিন্দু নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে বলেন, ‘এর ফলে বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।’ হিন্দু নেতারা ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়, ১০ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে ও ১১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে প্রতিবাদ করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উকিল লাইব্রেরিতে ত্রৈলোক্যনাথ বসুর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা হয়। ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধি দল লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে সাক্ষাত করে যে প্রতিবাদ লিপি দেন তাতে বলা হয়েছিল, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলে তা হবে আভ্যন্তরীণভাবে বঙ্গভঙ্গের সমতুল্য; তাছাড়া পূর্ব বঙ্গের মুসলমানরা প্রধানত কৃষক তাই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কোনো উপকারে আসবে না।’

১৯১২ সালের ২৮ মার্চ গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই প্রতিবাদ সভা করার জন্য দুদিন পূর্বে ২৬মার্চ যে প্রস্তুতি সভা হয়, তাতেও তিনিই সভাপতিত্ব করেন। [সূত্র: ইতিহাসের দিনলিপি (দ্বিতীয় খন্ড, ৪র্থ পাঠ, কলিকাতা ১৯৯৫) -ড. নীরোদ বরন হাজরা, বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ (পৃষ্ঠা-২০৭, ঢাকা, বাংলাদেশ) -মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান, একশ বছরের রাজনীতি (পৃষ্ঠা-৭১, ঢাকা-২০১০) -আবুল আসাদ]। মোদ্দা কথা, যে মানসিকতা নিয়ে হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন সেই একই মানসিকতায় তারা পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হিন্দুদের বিরোধিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা যেন বাতিল না হয়ে যায় সে জন্য নবাব সলিমুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেন। নীলক্ষেত ও শাহবাগের যে এলাকা জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে তার সমুদয় জমি নবাব সলিমুল্লাহর দান করা খাজা এস্টেটের।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীদের নেতৃত্ব দেন ১৯৪৬ সালে বাংলা ভাগের প্রস্তাবক হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পিতা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. আশুতোষ মুখার্জী। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার গড়িমসি করতে থাকলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও নবাব সলিমুল্লাহর মানসপুত্র নামে পরিচিত শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হকের অব্যাহত তৎপরতার কারণে অবশেষে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়।

ঢাকার কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত পূর্ব বঙ্গের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে, হিন্দু নেতাদের এই শেষ দাবিটি ব্রিটিশ সরকার মেনে নেয়ার পর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা বন্ধ করেন। ফলে সকল ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হবার পর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরদারী ও নিয়ন্ত্রণ থেকে পূর্ব বঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীনতা লাভ করে।

আজ ১ জুলাই, ২০২১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার একশত বছর পার করল। সকল বিরোধিতা, বৈরিতা এবং প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যারা বাংলার চাষাভুষা মুসলমানদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে জমি দাতা নবাব সলিমুল্লাহ এবং তার মৃত্যুর পর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরেবাংলা এ.কে ফজলুল হক অন্যতম। তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।

লেখক: সদস্য, স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ

মতামত শিক্ষা