রাজধানীতে শতাধিক কিশোর গ্যাং নজরদারিতে শেল্টারদাতারা

রাত ৮টা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। মিরপুর-১১ এর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসের অপেক্ষায় এক তরুণী। পাশে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। এর মধ্যেই বেপরোয়া গতিতে তিনটি মোটরসাইকেলযোগে পাঁচজন
সেখানে থামে। তাদের সবার বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলছিল। মেয়েটি সেখান থেকে সরে পাশের দোকানের দিকে হাঁটতে চেষ্টা করতেই পথ আগলে দাঁড়ায় তাদের একজন।

অশোভনীয় ভাষা ব্যবহার করে বাইকের পেছনে উঠতে বলে। মধ্যবয়সী লোকটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিলেন। লালমাটিয়া মহিলা কলেজের এই ছাত্রী দ্রুত একটি দোকানে ঢুকে রক্ষা পায়। মোহাম্মদপুরের বাসায় পৌঁছে ঘটনাটি বড় বোনকে জানালেও এ নিয়ে থানা পুলিশকে কোনো অভিযোগ দেয়া হয়নি। এরকম ঘটনা রাজধানীতে ঘটছে প্রায়ই। খুব কম অভিযোগই যাচ্ছে থানা পুলিশে। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর পাড়া-মহল্লাসহ প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই গড়ে উঠেছে এরকম কিশোর গ্যাং। গোয়েন্দা তথ্য মতে, রাজধানীতে শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। বেশিরভাগ গ্যাং সদস্য অপরাধমূলক কাজে জড়িত। গ্যাংয়ের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতিমধ্যে গ্যাং সদস্যসহ তাদের শেল্টারদাতাদের তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দারা।
গত ২৩শে জুন মিরপুর থেকে এই কিশোর গ্যাংয়ের তালিকাভুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাজিরুর রহমান জানান, এই গ্রুপের সদস্যরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য লোকজনকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদান ও চাঁদাবাজি করে।
নিজেদের স্বার্থে এসব গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে সুবিধাবাদীরা। বিশেষ করে স্থানীয় নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া এসব গ্যাং। যৌন হয়রানি, মাদক সেবন ও বিক্রিতে জড়িত তারা। এমনকি ভূমি দখলেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই গ্যাংয়ের সদস্যদের। এমন গ্যাং রয়েছে রামপুরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ প্রায় সব এলাকাতেই। কিশোর গ্যাংয়ের অবাধ অপরাধের কারণে প্রায়ই ঘটছে হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। এসব গ্যাংয়ের হোতারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করেন কিশোরদের। এমনকি অতীতে স্থানীয় নির্বাচনে কিশোরদের ব্যবহার করেছেন প্রার্থীদের অনেকে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, রামপুরা, উলন, মধুবাগ, বেগুনবাড়ি, মগবাজার, খিলগাঁও এলাকায় গড়ে উঠেছে অন্তত ১০-১২টি কিশোর গ্যাং। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দলবেঁধে রাস্তায় নামে। দামি মোটরসাইকেল নিয়ে পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন গ্যাং মহড়া দেয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ঠেকাতে প্রায়ই মাঠে নামে পুলিশ। তারপরও থামছে না তাদের দৌরাত্ম্য। এই গ্যাংগুলো নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। রামপুরা এলাকায় দুই নারী নেত্রীসহ কয়েক দাগি সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণ করছে কিশোর গ্যাং। কোনো কোনো গ্যাংয়ের সদস্যরা আড্ডা, হইহুল্লোড় করে সময় কাটালেও ওই এলাকার বেশিরভাগ গ্যাং সদস্যরা মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। কাইল্যা পলাশ কারাগারে থাকলেও তার হয়ে রামপুরা এলাকায় গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছে তুষার। কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হয়ে কিশোর-তরুণদের সংগঠিত করে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এই চক্র। এই গ্যাংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে যুব মহিলী লীগের এক নেত্রীর নেতৃত্বাধীন গ্যাং। ইতিমধ্যে দুই গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ ও মামলা দায়েরের ঘটনাও ঘটেছে। মগবাজার এলাকার একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে অন্যতম হৃদয় গ্যাং। এই গ্যাংয়ের প্রধান টিকটক হৃদয় নারী পাচার ও নির্যাতনের অভিযোগে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছে। ভারতের ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই, কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি অসহায় মেয়েদের পাচার করতো হৃদয় গ্যাং।
মিরপুর-১০ ও ১১ এলাকায় রয়েছে একাধিক কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের মধ্যে অন্যতম তালুকবদার গ্যাং, মানিক গ্যাং, পল্টন গ্যাং, আলীবাবা গ্যাং। এরকম বিভিন্ন নামে পরিচিত এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের অনেকে মাদক, ফুটপাথে চাঁদাবাজি ও জবর-দখলে জড়িত। স্থানীয় সূত্র মতে, এসব কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মাদক বিক্রি ও জমি দখলে গিয়ে গ্রেপ্তার হলে থানা পুলিশ থেকে তাদের ছাড়িয়ে নেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, কাউন্সিলর মানিক ও ঢাকা উত্তরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের আমান উল্লাহ আমানের ছত্রছায়ায় মিরপুরের পল্লবীতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং।
মিরপুর-১১ এলাকার একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে, ইমরান তালুকদার ওরফে লাদেন সোহেল, মো. আলমগীর বাদশা ওরফে হৃদয়, শেখ ইসতিয়াক ইফতি ওরফে তুষার ও মো. রানা হোসেন। ইতিমধ্যে লাদেন ছাড়া তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা স্থানীয় কাউন্সিলর মানিকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এই গ্যাংয়ে বাবু, তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী আরমান ও হত্যা মামলার আসামি রুবেলসহ রয়েছে অর্ধশতাধিক কিশোর ও যুবক।
মিরপুর-১০ এলাকায় অবাধে নানা অপকর্মের জন্ম দিচ্ছে পলটন বাহিনী। কিশোরদের এ বিশাল গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে পল্টন নামে এক যুবক। গ্যাংয়ে মাদক ব্যবসায়ী মফিজ, মাদক ব্যবসায়ী রাজীব, মিজান, বাপ্পিসহ শতাধিক যুবক-কিশোররা রয়েছে। পল্টন বাহিনীকে ওয়াপদাহ বিহারি ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা ও ফুটপাথ দখল করে দোকান ভাড়া দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পল্টন ছাত্রদলকর্মী হলেও তাকে প্রশ্রয় দেন কাউন্সিলর মানিক। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে শুরু করে হোপ স্কুল পর্যন্ত ফুটপাথ বসিয়েছে এই গ্যাং। একইভাবে বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় জমি জবরদখলের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে গত ২৬শে জুন কিশোর গ্যাং ‘বিগ বস’র ৬ সদস্যকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১। র‌্যাব জানায়, গত শনিবার ভোরে উত্তরা-পূর্ব থানার আইচি হাসপাতালের পূর্ব পাশে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বাহাউদ্দিন হাসান শাওন, মো. শাকিল, মো. রিফাত হোসেন, মামুন, মো. সাইফুল ইসলাম রিফাত ও মো. রাব্বীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে একটি রামদা, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি ছোরা ও চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। উত্তরা এলাকায় বিগ বস গ্রুপ, ডেঞ্জার সেভেন গ্রুপ, কাটার গ্রুপ, হৃদয় গ্রুপ, নন-স্টপ ড্যান্স গ্রুপ ছাড়াও আরও কয়েক গ্যাং রয়েছে। র‌্যাব-১ এর সহকারী পুলিশ সুপার নোমান আহমদ জানান, এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস?্যরা মাদক সেবন, র‌্যাগিং, ইভটিজিং, ছিনতাই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও শেয়ারসহ নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
লালবাগ এলাকায় রয়েছে কয়েক কিশোর গ্যাং। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা সন্ধ্যার পর শহীদ মিনার, টিএসসি, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে আড্ডা দেয় এই গ্যাংয়ের সদস্যরা। গভীর রাতে হাতিরঝিল ও পুরান ঢাকা এলাকায় গ্যাংয়ের সদস্যদের দেখা মেলে প্রায়ই।
এসব বিষয়ে ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (মিডিয়া) ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হয়েছে। রাজধানীতে ৭৮টি গ্যাংয়ের তথ্য রয়েছে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এ বিষয়ে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সেইসঙ্গে শেল্টারদাতাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ