জয়নাল আবেদীন
‘আঠারো বছর বয়সের ভয় নেই,… এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের তারুণ্যের এই আঠারো এই যুগে কারো কারো ক্ষেত্রে ভয়ংকর বয়স হয়ে উঠছে। কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই কেউ কেউ নাম তুলছে পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ে। ফেসবুক, টিকটকের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফর্মেও নীরবে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। ভার্চুয়াল বিরোধ রূপ নিচ্ছে বাস্তব সংঘর্ষে। পোস্ট কিংবা লাইক-কমেন্টের মতো তুচ্ছ বিষয়ও বড় সহিংসতা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে—রাষ্ট্রীয় তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন জারি রাখা।
পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের ছাত্র শিশির বেপারী মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই হাতে পায় স্মার্টফোন। সেই সূত্রে বখাটেপনায় হাতেখড়ি। টিকটকে আইডি খুলে শুরু হয় নিজেকে উপস্থাপনা। কয়েক মাসেই লাখের অধিক অনুসারী জুটে গেলে তার মধ্যে চলে আসে ‘হিরো’ ভাব। হয়ে ওঠে টিকটকের ‘গুরু’। গ্লোরিয়ায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলতে থাকে টিকটক ক্লাস! টিকটকে কিভাবে নিজেকে তুলে ধরবেন, আকর্ষণীয় অভিনয়ের কৌশলই বা কী—জানতে শিশিরের পিছু নিতে শুরু করে অনুসারী দলও। এই টিকটক ‘গুরু’ এখন কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অনলাইনে নয়, তার দিন কাটছে জেলহাজতে। ‘টিকটক-স্টার’ হওয়ার কৌশল রপ্ত করতে গাজীপুর থেকে আসা এক কিশোরীকে গ্লোরিয়ার ওই বাসায় তিন দিন আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বরে শিশিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তার স্কুলজীবনের এক সহপাঠী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্য দশজনের মতোই স্কুলে আসা-যাওয়া করত শিশির। সম্ভবত তখন আমরা নবম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন দেখি ওর হাতে স্মার্টফোন। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে ও। নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। আমরা সহপাঠীরা বুঝতে পারলাম শিশির বখে যেতে শুরু করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শিশির এক পর্যায়ে নেশাও ধরে। তবে আলাদা কলেজে ভর্তি হওয়ায় এসএসসির পরে ওকে আর দেখিনি। বহুদিন পরে খবরে দেখি, এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে সে গ্রেপ্তার।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন তথ্য-প্রযুক্তির সুবাদে সারা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। যা পাচ্ছে লুফে নিচ্ছে কিশোররা। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের জায়গাটা তারা গুলিয়ে ফেলছে। এ জন্য অভিভাবকদের দায়ও কম নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সন্তানরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কতটুকু সময় ব্যয় করছে, আর স্মার্টফোনটা কী কাজে লাগাচ্ছে অভিভাবকদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলে-মেয়েরা স্মার্টফোনে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছে। তাই তাদের প্রতি নজরদারি আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত বছরের মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে গেছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে এটিকে ভালো কাজে ব্যবহার করলেও কেউ কেউ জড়িয়ে যাচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। টিকটক, লাইকির মতো ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে শিখছে অপরাধের নানা কৌশল। এমনকি এসব প্ল্যাটফর্মে সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে অনেক গ্রুপ। বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা করোনাকালে অনলাইনকেই বেছে নিয়েছে যোগাযোগের বড় মাধ্যম হিসেবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলাকাভিত্তিক ‘কিশোর গ্যাং’গুলো বিভিন্ন পার্ক, খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্র হয়। টিকটকের ভিডিও তৈরির নামে তারা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভ টিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। কাঙ্ক্ষিত লাইক-কমেন্ট পেতে খোলামেলা পোশাকে দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গিও তারা করে থাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ‘টিকটক হিরোরাই’ পর্যায়ক্রমে নাম লেখাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ে। অন্যকে স্টার বানানোর ফাঁদ পেতে নানা রকম হয়রানি করছে। উঠতি কিশোরীদের ফাঁদে ফেলে প্রেমের সম্পর্ক গড়ছে। তারপর সুযোগ বুঝে তাদের সঙ্গে একান্তে কাটানো সময়কে মুঠোফোনে ধারণ করে রাখে। এরপর তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে নতুন নতুন প্রতারণা।
চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধেও জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। গত মাসে পুরান ঢাকার ওয়ারী থেকে কিশোর গ্যাংয়ের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তখন র্যাব জানিয়েছিল, এই কিশোর অপরাধীরা ডাকাতি-ছিনতাই ছাড়াও মাদক সেবন, খুচরা মাদকের কারবার, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং, পাড়া-মহল্লায় মারামারিতে জড়িত ছিল। এমনকি ভাড়ায় খেটে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পেশিশক্তির মহড়া পর্যন্ত দিত।
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় করা পোস্ট বা মন্তব্য (কমেন্ট) পছন্দ না হওয়ায় সৃষ্ট বিরোধ থেকে খুনাখুনিতে পর্যন্ত জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। চলতি সপ্তাহে ময়মনসিংহের ভালুকায় ঘটেছে এ ধরনের ঘটনা। ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টের জের ধরে স্থানীয় দুই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। এতে প্রাণ হারাতে হয় একটি গ্রুপের সদস্য কলেজছাত্র সায়েম খানকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এখন আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরে আছি। যেখানে নানা রকম অস্থিরতা বাড়তে দেখা যায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রেও একসময় বিশাল গ্যাং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যেটি এখন বাংলাদেশে হচ্ছে। সামাজিক পটপরিবর্তনের কারণে পুরনো অনুশাসনগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে।’ তিনি আরো বলেন, পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চরিত্র গঠনের যে ভিত্তি তৈরি হতো, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে অভিভাবকদের সচেতনতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এই অপরাধ বিজ্ঞানী। তাঁর মতে, আধুনিকায়নের সঙ্গে পুরনো সমাজব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। পুরনো অনুশাসনগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে এতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রেরও। দেশে বর্তমানে যে কয়েকটি সংশোধনাগার রয়েছে, তা মোটেও উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত নয়। সেখানে মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই।