রহমত রহমান: যাত্রাবাড়ী এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম। ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে হতবাক তিনি। লাইসেন্স নবায়ন ফি ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে তাকে উৎসে কর দিতে হবে তিন হাজার টাকা। ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে ৭৫ টাকা। ৫০০ টাকা নবায়ন ফি’র এর সঙ্গে কর ও ভ্যাট হিসেবে বাড়তি দিতে হচ্ছে ৩ হাজার ৭৫ টাকা। আমিনুল ইসলামের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছে ৩ হাজার ৭৫ টাকা বাড়তি বোঝা।
ব্যবসায়ী আমিনুল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘৫০০ টাকার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফির সঙ্গে কেন আমাকে ৩ হাজার ৭৫ টাকা দিতে হবে। আমার তো সে রকম আয় নেই। ট্রেড লাইসেন্স না থাকলে বা নবায়ন না করলে সিটি করপোরেশন ঝামেলা করে। সে জন্য নবায়ন করতে এসেছি। এখন এ বাড়তি ফি তো আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের জন্য বোঝা, এত বেশি কর কেন দেব?’
আমিনুল ইসলামের মতো লাখ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় উৎসে কর আর ভ্যাটকে তাদের জন্য বোঝা বলে মনে করেন। সে জন্য বেশিরভাগ ব্যবসায়ী লাইসেন্স নবায়নে অনীহা দেখাচ্ছেন। এতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কমে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাদের ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়ন করতে ফি’র পরিমাণ বেশি। তার ওপর মাত্রাতিরিক্ত কর ও ভ্যাট দিতে হচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ আয়করের আওতায় পড়বে না। কিন্তু লাইসেন্স নবায়নের সময় তাদের থেকে তিন হাজার টাকা করে উৎসে কর নেয়া হচ্ছে; যা আর ফেরতও পাবেন না। সে জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নবায়নে কর বাতিলের দাবি জানান তারা।
অন্যদিকে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় নির্দিষ্ট হারে উৎসে কর দিতে হয়। যার কারণে লাইসেন্স নবায়ন অনেক কমে গেছে। তাদের আয়ের একটি বড় অংশ আসে লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন থেকে। অর্থ বিল সংশোধনের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়নকে লাইসেন্স নবায়নের সময় উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে। উৎসে করের পরিমাণ বেশি হওয়ায় লাইসেন্স নবায়নে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কারণ করোনায় তাদের আয় কমেছে। সে জন্য উৎসে কর আদায় কার্যক্রমের বাধ্যবাধকতা থেকে সিটি করপোরেশনকে বাদ দিতে সম্প্র্রতি অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আয়ের একটি অন্যতম উৎস হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবসা, বৃত্তি, পেশা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও এর নবায়ন। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর অধীনে প্রণীত আদর্শ কর তফসিল ২০১৬-এর ১০(৪) ধারা মোতাবেক করপোরেশন তার অধিক্ষেত্রে এই ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। ২৩ মে পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রেকর্ডভুক্ত মোট ট্রেড লাইসেন্স সংখ্যা দুই লাখ ৩২ হাজার ৯৭৭টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত ১৮টি ওয়ার্ডে দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ট্রেড লাইসেন্স আওতায় আসার কারণে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিদ্যমান ট্রেড লাইসেন্সসমূহের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রেড লাইসেন্স ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসমূহের অনুকূলে প্রদান করা হচ্ছে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ মালিকের আয় সীমিত।
এতে আরও বলা হয়, অর্থ আইন, ২০০৭ দ্বারা আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ৫২ (ক) সংশোধন করে সিটি করপোরেশনকে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সময় প্রতিটি ট্রেড লাইসেন্স বাবদ আরও ৫০০ টাকা উৎসে কর হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুকূলে আদায় করতে হয়। অর্থ আইন, ২০১৯-এর ২৭ ধারায় এই উৎসে কর ৫০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। এছাড়া নিয়মানুসারে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়নের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আদায় করতে হচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ দ্বারা পরিচালিত হয়। যাতে এনবিআর তথা অন্য সংস্থার অনুকূলে রাজস্ব আদায়ে সিটি করপোরেশনকে বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় নতুন ১৮টি ওয়ার্ডসহ অধিকাংশ ব্যবসায়ী ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করে। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পক্ষে ট্রেড লাইসেন্স ফি-এর সঙ্গে বর্ধিত তিন হাজার টাকা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বাবদ পরিশোধ করা কষ্টকর হওয়ায় অনেকেই তাদের বিদ্যমান লাইসেন্স নবায়ন করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে সিটি করপোরেশনের নিয়মিত ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন কার্যক্রম ব্যবহƒত হচ্ছে। ফলে কাঙ্খিত রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে এনবিআরের অনুকূলে তিন হাজার টাকা উৎসে কর আদায় কার্যক্রমের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করা হলে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে।
চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্যে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের জন্য উৎসে কর বাবদ ৩ হাজার টাকা আদায়ে বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি প্রদান ও এনবিআর কর্তৃক পৃথকভাবে তার প্রাপ্য ব্যবসায়ীদের নিকট হতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আদায় করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন মেয়র।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। আরিফুল হক এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মেয়র মহোদয় বিষয়টি জানিয়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছেন। এনবিআর থেকে এখনও কোনো উত্তর আসেনি। ফলে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রিম এই কর নেয়া হয়। ব্যবসায়ী বছর শেষে রিটার্ন দাখিলের সময় এই কর দেখাবেন। করদাতা এই কর রিটার্নে সমন্বয় করতে পারবেন। অতিরিক্ত দিলে ফেরত নিতে পাবেন। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা রিটার্ন দাখিল ও কর প্রদানে বাধ্য হবেন।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে এই বাড়তি করের মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে দোকান মালিকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ সময় ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে এই বাড়তি কর তাদের আরও বিপাকে ফেলবে। ব্যবসায়ীর আয় হলে আয়কর দেবেন। কিন্তু উৎসে আদায় করার ফলে ছোট ব্যবসায়ীরা, যারা আয়করের আওতায় পড়বেনই না, তাদেরও আয়কর দিতে হচ্ছে। তিনি এই কর বাতিলের দাবি জানান।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৬ লাখ। আর এসএমই ফাউন্ডেশন এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৩ হাজারের বেশি। এসবের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি হচ্ছে কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা সিএমএসএমই খাতের।