আবদুল্লাহ আল মামুন
মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তৃণমূলে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। এ বিরোধ সহিংসতায়ও রূপ নিচ্ছে। দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেকোনো উপায়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টায় বাড়ছে কোন্দল। এদিকে মন্ত্রী-এমপিরাও ছাত্রলীগের সাবেক এসব নেতাকে মাঠ ছেড়ে দিতে চান না। এতে তৃণমূলে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে বাড়ছে উদ্বেগ।
স্বাধীনতাপূর্ব এবং পরবর্তী তিন দশকের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা। এঁদের অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। কিন্তু গত দুই দশকে নেতৃত্বে আসা ছাত্রলীগের ১২ জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে মাত্র একজন দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১২ জনের মধ্যে সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অপসারণ করা হয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তৃণমূলে কোন্দলে জড়িয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় কেন্দ্রের আস্থা হারাচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। সে কারণেই একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পরও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন না। জায়গা হচ্ছে না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৮৩-১৯৮৫) জাহাঙ্গীর কবির নানক গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য পেশার মতোই রাজনীতিতে নিরলস চেষ্টা এবং পরিশ্রম থাকতে হবে। দলে কনট্রিবিউশন থাকতে হবে। না থাকলে দূরত্ব তৈরি হয়। তখন কোথাও থাকা না থাকার বিষয় আসে। তিনি বলেন, আমি মনে করি ছাত্রলীগ নেতা তৈরির কারখানা। তাই আমারও প্রশ্ন, সমকালীন ছাত্রনেতারা কেন হারিয়ে যাচ্ছেন?
জাহাঙ্গীর কবির নানক মৌলভীবাজারের জুড়ীতে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হাজি শফিক আহমেদের বাড়িতে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের অনুসারীদের হামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় এবং দুঃখজনক। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যারা দিয়ে এসেছে, তাদের কিছু হিসাব-নিকাশ করে কাজ করা উচিত। শুধু বিরুদ্ধাচরণ করলেই হবে না, মুরব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৮৬-১৯৮৮) আবদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের নেতৃত্বে আসতে আড়াই দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্যরাও যাঁরা অপেক্ষা করছেন ও ধৈর্য ধরছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মূল দলে জায়গা হবে।’ সমকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের কোন্দলে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বড়দের সম্মান জানাতে হবে। আওয়ামী লীগে শর্টকাট জায়গা নেই। এখনই সব কিছু করায়ত্ত করতে হবে বা নিতে হবে—এ রকম মানসিকতা না রাখাই ভালো।’
আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরেছি। তার মূল্যায়ন করেছেন দলের সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদেরও ধৈর্য ধরতে হবে। সিনিয়র নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে হবে। কাজ করতে গিয়ে দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে। কোনো অবস্থায় তাঁদের অসম্মান করা যাবে না।’
গত ১৩ জুন মৌলভীবাজারের জুড়ীর একটি ঘটনায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইনের অভিযোগ, ওই দিন রাতে তাঁর ওপর হামলার চেষ্টা করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের অনুসারী ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ অভিযোগ এনেই জাকিরের অনুসারীরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারী যুবলীগ নেতা আহমেদ কামাল অহিদের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় আহমেদ কামাল অহিদের বাবা প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হাজি শফিক আহমেদ স্ট্রোক করেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা ভালো নয়।
জুড়ীর ঘটনা সম্পর্কে দলীয় সূত্র জানিয়েছে, একটি গাড়ি একটি মোটরসাইকেলকে চাপ দিয়ে জুড়ী বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় এসে দাঁড়ায়। দুই মোটরসাইকেল আরোহী জানতেন না ওই গাড়িতে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন রয়েছেন। তাঁরা ওই গাড়ির সামনে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে চালকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন সে মোটরসাইকেলকে চাপ দিয়ে চলে এলো। এ জন্য তারা গাড়ির চালককে বকাঝকা করেন। এ সময় গাড়ি থেকে নেমে আসেন জাকির হোসাইন। কেন তাঁর গাড়ির চালককে বকাঝকা করা হচ্ছে, তা নিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীদের সঙ্গে তর্কে জড়ান। এ সময় সেখানে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে জাকির হোসাইন এই ঘটনাকে তাঁর ওপর হামলার চেষ্টা বলে থানায় অভিযোগ করেন এবং ওই রাতেই তাঁর অনুসারীরা যুবলীগ নেতা আহমেদ কামাল অহিদের বাড়িতে হামলা করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, মৌলভীবাজার-১ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন জাকির হোসাইন। এই মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বর্তমান সংসদ সদস্য এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। এই কারণে তুচ্ছ একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে মাঠ দখলের চেষ্টা করছেন ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, বাড়িতে হামলার পর প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হাজি শফিক আহমেদ স্ট্রোক করায় তাঁদের অনেকেই অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ক্ষুব্ধ। বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এই ঘটনায় জাকিরকে সতর্ক করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন গাইবান্ধা-৫ আসনে দলীয় মনোনয়ন চান। একে কেন্দ্র করে ওই আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড বিরোধ তৈরি হয়েছে। গত নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। এই বিরোধ দিন দিন আরো বাড়ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এখন দুই ধারায় বিভক্ত।
ছাত্রলীগের আরেক সাবেক সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-৭ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তাঁর ওই আসনের এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। মোজাম্মেল হোসেন মারা যাওয়ার পর দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন আমিরুল আলম মিলন। এখানেও আওয়ামী লীগে বিভক্তি রয়েছে।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার আওয়ামী লীগ অথবা সহযোগী অন্য কোনো সংগঠনে ভালো কোনো পদ পাননি। ফরিদপুর-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় এমপি আবদুর রহমানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান ছিলেন ছাত্রলীগের ১৯৮৬-১৯৮৮ মেয়াদের কমিটির সাধারণ সম্পাদক। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন সাবেক সচিব মনজুর হোসেন।
১৯৯৮-২০২১। এই সময়ের ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র নজরুল ইসলাম বাবু (সাধারণ সম্পাদক) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।