নিরঞ্জন রায়
আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা হলো সব দিক আটঘাট বেঁধে মানসম্পন্ন সব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই নতুন কোনো কিছু শুরু করে দেওয়া হয়। ফলে পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দেয় এবং শুরু হয়ে যায় হৈচৈ। সেই সঙ্গে নতুনভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ফলে অনেক চেষ্টা করেও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল চালু করা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, মোবাইল ফোন এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অবারিত করাসহ সর্বক্ষেত্রে একই অবস্থা লক্ষ করা গেছে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিণতি যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা বাংলাদেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে, এখনো পারছে এবং ভবিষ্যতেও পারবে। এখন শত চেষ্টা করেও এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেননা নতুন কিছু শুরুর আগে যতটা প্রয়োজন ততটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু একবার মানুষ অনিয়ন্ত্রিত সেবায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা আর সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। একইভাবে কোনো রকম পরিচয়পত্র বা আইডি প্রদানের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত না করেই মোবাইল ফোনের প্রচলন চালু এবং সহজলভ্য করা হয়েছে। ফলে নামে-বেনামে একাধিক সিম নিয়ে সেসব মোবাইল দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ ক্ষতিকর সব অপকর্ম করা হয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সব মোবাইল ব্যবহারকারীর পরিচয়পত্র বা আইডি নিশ্চিত করতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
প্রয়োজনীয় সব নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত না করে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দেশে ই-কমার্স চালু করা এবং সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইভ্যালি কেলেঙ্কারি হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় অঘটন। সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, এই অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২১৪ কোটি অগ্রিম গ্রহণ করেছে, কিন্তু এর বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করেনি। অর্থাৎ গ্রাহকরা অনলাইনে ২১৪ কোটি টাকার অর্ডার দিয়ে অর্থ পরিশোধ করলেও পণ্যসামগ্রী এখনো বুঝে পায়নি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে এই কম্পানির মোট দায় ৪০৭.১৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া অর্থের পরিমাণ ২১৩.৯৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন মার্চেন্টের কাছ থেকে বাকিতে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করা অর্থের পরিমাণ ১৮৯.৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু কম্পানির কাছে আছে মাত্র ৬৫.১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই কম্পানির দেউলিয়া হতে আর বাকি নেই। এই ঘটনার কারণে গ্রাহকরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, সেই সঙ্গে দেশের ই-কমার্স খাতও বড় ধরনের একটা ধাক্কা খাবে।
ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার যে দুটি ন্যূনতম শর্ত রয়েছে তা এখানে মেনে চলতে আদৌ বাধ্য করা হয়নি। আর এই দুটি শর্ত হলো পণ্য ফেরত পলিসি এবং অর্থ পরিশোধ পলিসি। ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১-এর ৩.৩.২ অনুযায়ী ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থিত হলে সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অথচ অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এই শর্তটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রয় করা পণ্যসামগ্রী ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং অর্থ পরিশোধের শর্ত। অনলাইনে কোনো কিছু অর্ডার দেওয়ার সময় উল্লেখ থাকে যে ডেলিভারি কবে নাগাদ হতে পারে। সেই বুঝেই একজন ক্রেতা অর্ডার দেবেন। যেমন—অর্ডার দেওয়া পণ্য যদি ডেলিভারির জন্য মজুদ না থাকে এবং সে ক্ষেত্রে যদি সরবরাহকারীর কাছ থেকে ডেলিভারি দিতে হয়, তাহলে এই পাঁচ দিনের শর্ত মেনে চলা মোটেই সম্ভব নয়। আমি আমাজনে বাংলাদেশের একটি বই অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি ডেলিভারি দিতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগবে, তাই আর অর্ডারটি প্লেস করিনি।
ই-কমার্সের বা অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কখন ক্রেতার হিসাব থেকে অর্থ নেওয়া হবে সেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা একটি প্ল্যাটফর্ম মাত্র। এই প্রতিষ্ঠানের বিক্রীত পণ্য যে সব সময় তাদের নিজস্ব গুদাম থেকে যাবে তেমন কোনো কথা নেই। তাদের অনুমোদিত সরবরাহকারীর কাছ থেকেও সরাসরি ক্রেতার কাছে চলে যেতে পারে। ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে ঠিকমতো মূল্য পাওয়া এবং যথাসময়ে পণ্যসামগ্রী বুঝে পাওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকে। তা ছাড়া এই প্ল্যাটফর্মে কেনাকাটা নগদে করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন হয় ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ডের। তাই ক্রেতা এবং বিক্রেতার অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে, যেখানে ক্রেতা অনলাইনে অর্ডার দেওয়ার সময় তাঁর ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের নম্বর প্রদান করবেন; কিন্তু সেই কার্ড থেকে তাত্ক্ষণিক অর্থ নেওয়া হবে না। অর্ডার দেওয়া পণ্যসামগ্রী ডেলিভারির উদ্দেশ্যে শিপমেন্ট হওয়ার পরই ক্রেতার দেওয়া ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড চার্জ করে পণ্যের মূল্য আদায় করা হয়। এখানে অগ্রিম অর্থ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। উন্নত বিশ্বের ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই এই পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলে। যে কারণে ব্যাংক বা তৃতীয় কোনো পক্ষের শিপমেন্ট নোটিফিকেশন ভেরিফাই করে পেমেন্ট প্রসেস করার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের দেশে যেহেতু ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতি মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাতে পারে, তাই তাদের পেমেন্ট প্রসেস করার দায়িত্বটি ব্যাংক বা তৃতীয় কোনো পক্ষের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে, যারা শুধু শিপমেন্ট নোটিফিকেশন পাওয়ার পরই সেই অর্ডারের পেমেন্ট প্রসেস করবে। আর এটা নিশ্চিত করা গেলে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে মূল্য পরিশোধের পরও পণ্যসামগ্রী না পাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।
ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাকাটার সময় ক্রেতা সশরীরে গিয়ে জিনিসপত্র ক্রয় করে না। অনলাইন পোর্টালে দেওয়া ছবি এবং পণ্যের বর্ণনা দেখেই ক্রয় অর্ডার দিতে হয়। সে কারণে ক্রেতা যদি ডেলিভারি পাওয়ার পর সন্তুষ্ট না হয় সে ক্ষেত্রে বিনা বাক্যে এবং খুব সহজে ক্রয় করা পণ্য ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা অনলাইন কেনাকাটা বা ই-কমার্সের অন্যতম পূর্বশর্ত। ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা জনপ্রিয় করে তুলতে হলে প্রতিটা ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে এই সহজ শর্তের রিটার্ন পলিসি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। এই ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা উন্নত বিশ্বের যেমন জনপ্রিয়, তেমনই সফল। এবং সেসব উন্নত দেশের ধারণা নিয়েই আমাদের দেশে এই ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা চালু করা হয়েছে। তাই উন্নত দেশে যেসব শর্ত এবং মানদণ্ড মেনে এই ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা জনপ্রিয় এবং সফল হয়েছে, সেগুলো আমাদের দেশেও যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে, অন্যথায় ইভ্যালির মতো অঘটন ঘটতেই থাকবে।
দেশে ই-কমার্স যাত্রা শুরু করতে না করতেই ইভ্যালি কেলেঙ্কারি দেশের ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। অথচ ই-কমার্স বা অনলাইন শপিং এখন এক নতুন বাস্তবতা। আমরা স্বীকার করি বা না করি আগামী দশকের ব্যবসা-বাণিজ্য যে যথেষ্টই অনলাইননির্ভর হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি উন্নত বিশ্বের অনলাইন ব্যবসা সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছে যাওয়ায় বিশ্বের বিশাল বিশাল অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেমন আমাজন, ওয়ালমার্ট এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে। ভারতে তো এসব কম্পানি এরই মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বসে আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জনসংখ্যার কারণে তাদের দৃষ্টি যে আমাদের দেশের দিকেও আছে তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ রকম অবস্থায় ইভ্যালি কেলেঙ্কারি আমাদের দেশের ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার ভবিষ্যতের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়। তাই এ ব্যাপারে এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে কঠোর নিয়ম, তদারকি এবং জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যাতে আর কোনো ইভ্যালি কেলেঙ্কারির ঘটনা না ঘটে এবং দেশে সুশৃঙ্খল এবং সুনিয়ন্ত্রিত ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্র অবারিত হয়।
লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com