মানিক মুনতাসির
মিজানুর রহমান। বয়স ৩৬। একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র কর্মকর্তা (ক্যাশ)। গত শুক্রবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। রামপুরা এলাকায় রাস্তার ওপর দাঁড়ানো একটি টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তার সামনে অন্তত ২০/২২ জন আছেন। ট্রাক এখনো পৌঁছেনি। কিন্তু লাইনে ততক্ষণে অর্ধশত মানুষ। কথায় কথায় তিনি জানান, ১০০ টাকা বা তার চেয়ে কিছু বেশি টাকা সাশ্রয় করতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় ঘণ্টাখানেক। পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল। দুই কেজি চিনি। এক কেজি ডাল কিনবেন। চোখে-মুখে নানা শঙ্কার ছাপ। এবার যে ঈদ বোনাস পেয়েছেন তা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছেন। ফলে আয়-ব্যয়ের হিসাবও মেলাতে পারছেন না। বাধ্য হয়েই এখন বাজেট কাটছাঁট করছেন। কিছুটা কম দামে জিনিস কিনতে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
মহামারী করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে টানা লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বেশির ভাগ কর্মজীবীর আয়ও কমেছে। ফলে এমন অবস্থা শুধু একজন মিজানুরের নয়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় সব মানুষেরই নাভিশ্বাস উঠেছে জীবন চালাতে। সংসার চালাতে না পেরে অনেকেই ঢাকা ছেড়েছেন, ছাড়ছেন। মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে বিশ্ববাসী। এর প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। লোকসান গোনার আশঙ্কায় বড় বড় অনেক কোম্পানি। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ জন্য চারদিকে ভর করেছে কর্মী ছাঁটাই আর কর্ম হারানোর আতঙ্ক। তারচেয়ে বড় সংকট হলো চিকিৎসা। নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের চিকিৎসা নিয়ে ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। তারা সরকারি সেবাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আবার বেসরকারি কোনো হাসপাতালের সেবা ব্যয়ও বহন করতে পারছেন না। সামর্থ্য থাকলেও করোনা সংকটের কারণে কাক্সিক্ষত ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা তারা পাচ্ছেন না। ফলে একদিকে চিকিৎসা অন্যদিকে জীবিকা নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।
বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি পরিবারের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে আছেন। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি হারানের ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেরই নিয়মিত বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের বেশির ভাগই এখন কর্মহীন। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরও বেশি কষ্টে রয়েছেন। তাদের সংকট আরও বেশি।
এদিকে খোদ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীর আঘাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। এখন সেটা আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থা দুুটি। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে আমাদের সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী করোনার আগে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০ দশমিক ৫ ভাগ দারিদ্র্য সীমার নিচে ছিল। চরম দরিদ্র ছিল ১০ ভাগ মানুষ। করোনা মহামারীর কারণে এখন সেটা দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে বেসরকারি কয়েকটি গবেষণা সংস্থা তথ্য প্রকাশ করেছে। এদিকে বিআইডিএসের সাম্প্রতিক জরিপে বলা হচ্ছে, করোনায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেশির ভাগ মানুষেরই আয় কমেছে। করোনার প্রথমদিকের সময়ে মানুষ ধারকর্জ করেছে বা সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালিয়েছে। এখন কিন্তু সে অবস্থাও নেই। মানুষ বাধ্য হয়ে খাবার কম খাচ্ছে। অনেকেই আবার কুলাতে না পেরে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। অর্থাৎ ভাত, আলু কিংবা ডালের পরিমাণ ঠিক রেখে মাছ, মাংস কম খাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সংকট কাটানো কঠিন হবে। তবে এখানে সরকারের আরও অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।