নিজস্ব প্রতিবেদক
জাতীয় সংসদের হুইপ ও পটিয়ার সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছোট ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাব গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামে নিজের গাড়িতে করেই অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ করতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ কারণে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ কাজে ব্যবহৃত হলেও গাড়িটি জব্দ করতে পারেনি পুলিশ। গাড়ি জব্দ তো দূরে থাক, হুইপের চাপে পড়ে অবৈধ অস্ত্র কারবারি নবাবকে হাতেনাতে আটকের পরও গাড়িসহ ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় শুধু নবাবের বাড়ির কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) মো. কায়েসকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
অবৈধ অস্ত্র কারবারিদের ব্যবহৃত গাড়ির বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান সেলকে বলেন, গাড়িটি সরকারি একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার। সেই কর্মকর্তার চাকরি ঢাকায়, থাকেনও ঢাকায়। গাড়িটি উনার ড্রাইভার ভাড়ায় চালান চট্টগ্রামে। তাই ভাড়া গাড়ি হওয়ায় অস্ত্র কারবারিদের ব্যবহৃত গাড়িটির কোনো তথ্য সংরক্ষণ না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের কোনো কর্মকর্তার এমন ভাড়ায় চালিত গাড়ি চট্টগ্রামে নেই। নেজাম উদ্দীন বলেন, ‘তা ছাড়া আমরা কায়েসকে তো অস্ত্রসহ গাড়ি থেকে আটক করতে পারিনি। গাড়িটি কেন জব্দ করব?’
এদিকে পুলিশের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কায়েস একটি প্রাইভেট কার যোগে অস্ত্র সরবরাহ করতে যাচ্ছিলেন। সেই প্রাইভেট কারটি পুলিশ চেকপোস্টে থামালে কায়েস গাড়ি থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন। সে সময় পুলিশ তাঁকে আটক করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত অবৈধ অস্ত্র সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত গাড়িটি ছিল হুইপের ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাবের। নবাব নিজেও সেই গাড়িতে ছিলেন। তিনি ও কায়েস অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ করতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ কাজে নবাবের ভাতিজা ও হুইপের ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী ওরফে শারুনও জড়িত। তবে নবাবের গাড়ি হওয়ায় হুইপের চাপে পড়ে গাড়িটি জব্দ না করেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। সেই সঙ্গে নবাবকেও ছেড়ে দিয়ে শুধু কায়েসকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। এ ছাড়া নবাবকে বাঁচাতে হুইপের শেখানো কথা বলতে পুলিশকে বাধ্য করা হয়। তাই অস্ত্র সরবরাহের গাড়িটি দেখানো হয় ভাড়ায় চালিত, যদিও সেই ভাড়ায় চালিত গাড়িটিরও নম্বরসহ কোনো তথ্যই মামলা ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করতে পারেনি কোতোয়ালি থানার পুলিশ।
পটিয়া আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া কায়েস হুইপের ভাই মুজিবুল হক নবাবের বাসার তত্ত্বাবধায়ক। কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে সব সময় ঘোরাফেরা করেন নবাব। নবাব ও কায়েসের বাড়ি পটিয়া থানার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামে। দুজনের বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। কায়েস উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার সময়ই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে চট্টগ্রাম শহরে আসেন।
তাঁরা বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে অস্ত্র সরবরাহ কাজে ব্যবহৃত গাড়িটি হুইপের ভাই নবাবের। নবাব নিজেও সে সময় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে গাড়িতে ছিলেন ও আটক হয়েছিলেন। কিন্তু হুইপের চাপে তাঁকে গাড়িসহ ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। নবাবকে বাঁচাতেই গাড়িটির কোনো তথ্য কাউকে দিচ্ছে না পুলিশ। কারণ গাড়ির তথ্য দিলে তো নবাব ধরা খেয়ে যাবেন।
এদিকে কোতোয়ালি থানার পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কায়েস বর্তমানে ডবলমুরিং থানাধীন সিডিএ ৫ নম্বর রোডের গ্রিন ডেল্টা প্রাইম ভ্যালির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পটিয়ার আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, এই গ্রিন ডেল্টা প্রাইম ভ্যালির একটি ফ্ল্যাটে বাস করেন হুইপের ভাই মুজিবুল হক নবাব। মূলত সেই সুবাদেই নবাবের সান্নিধ্যে এসেছেন কায়েস এবং তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালনের আড়ালে অস্ত্র কারবারে নেমেছেন।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার গভীর রাতে প্রাইভেট কার যোগে অস্ত্র সরবরাহ করতে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার হন কায়েস। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হালিশহর থানা এলাকা থেকে নজরুল ইসলাম আনু (২৫) ও সাজ্জাদ হোসেন সজীবকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়। তিনজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেছে পুলিশ। এরপর তিন আসামিকে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা অস্ত্র কারবারি। তাঁরা কম দামে অস্ত্র কিনে বেশি দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে আসছিলেন।
এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনই হুইপের ছেলে নাজমুল করিম ওরফে শারুন চৌধুরী ও তাঁর চাচা নবাবের অবৈধ অস্ত্র কারবার চক্রের সদস্য। সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার রাতে ওই গাড়িতে নবাব নিজেও ছিলেন। তাঁরা আন্ত জেলা ডাকাত চক্রের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করতে যাচ্ছিলেন। রাত দেড়টার দিকে নগরীর বক্সিরহাট মেসার্স কেসি বণিক জুয়েলার্সের সামনে পাকা রাস্তার ওপর চেকপোস্টে গাড়িটিকে থামালে নবাবের সঙ্গী কায়েস দরজা খুলে পালাতে চেষ্টা করেন। সন্দেহ হলে তল্লাশি করে হুইপের ভাই নবাবের কাছে অবৈধ অস্ত্র পাওয়া যায়। এরপর নবাবসহ কায়েসকে থানায় নিয়ে গেলেও রাতে হুইপ তদবির করে ভাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনায় নবাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। তদন্তের প্রয়োজনে এখন বেশি কিছু বলা যাবে না।’